তৈরি হয়েও পড়ে রয়েছে সেতু। —গৌতম প্রামাণিক
৯০ কোটি টাকা খরচ করে ভাগীরথীর উপর রেলসেতু নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে, তাও বছর ছয়েক হয়ে গেল। এখন দরকার একটা ‘লিঙ্ক রোড’।
মুর্শিদাবাদ স্টেশন থেকে সেতুর পূর্ব পাড় পর্যন্ত এবং পশ্চিম পাড় থেকে আজিমগঞ্জ জংশন পর্যন্ত দু’টি লিঙ্ক রোড মিলে মোট সাড়ে চার কিলোমিটার প্রস্তাবিত রেলপথের জন্য প্রয়োজন প্রায় ৫০ একর জমি। তার মধ্যে পূর্ব পাড়ে ৪৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্রায় চার কিলোমিটার ‘লিঙ্ক রোড’ নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় বছর চারেক আগে।
তার পর চার বছর ধরে ভাগীরথী দিয়ে জল গড়িয়েছে বিস্তর। চাকরি ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে মাত্র ৭ একর জমির জট না খোলায় পশ্চিম পাড়ের প্রায় ৪০০ মিটার ‘লিঙ্ক রোড’ তৈরির কাজ ভাগীরথীর বিশ বাঁও জলে তলিয়ে গিয়েছে। জমিজট কাটিয়ে দ্রুত নির্মাণকাজ শেষ করে রেলসেতু চালু করার দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন ‘সিটি মুর্শিদাবাদ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি’র সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য।
স্বপনবাবুর আইনজীবী পার্থপ্রতিম রায় বলেন, ‘‘রাজ্য ও রেলের ন’জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। চার সপ্তাহের মধ্যে ওই তাঁদের লিখিত বক্তব্য আদালতে জমা দিতে বলেছে ডিভিশন বেঞ্চ। তার প্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য থাকলে তা পরবর্তী দু’সপ্তাহের মধ্যে জমা দিতে হবে। তারও দু’সপ্তাহ পরে অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় সপ্তাহ পরে ওই মামলার শুনানি হবে বলে ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে।’’
ওই ন’জনের মধ্যে রয়েছেন মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও-ও। তিনি বলেন, ‘‘রেলসেতুর কাজের বিষয়ে আদালত জানতে চাইলে আমাদের বক্তব্য আদালতেই জানানো হবে।’’ সেতুর দায়িত্বে রয়েছেন পূর্ব রেলের শিয়ালদহ বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার (কনস্ট্রাকশান) অজয় কুমার। তিনি বলেন, ‘‘রেলকে ওই জমি কাগজে-কলমে দিয়েছে রাজ্য সরকার। তার ভিত্তিতে নির্মাণ কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করতে দরপত্র ডাকা হয়েছে। সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে তখন বাস্তবে জমির দখল দেওয়ার জন্য রাজ্যকে বলা হবে।’’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ৬৪টি বাড়ি-সহ ওই জমির মোট পরিমাণ ৭ একর। বছর দশেক আগে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রথম দিকে আজিমগঞ্জের মাহিনগর এলাকায় বাড়িঘর-সহ ৭ একর জমির মালিক ছিলেন ১০৩ জন। জমির বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ ও রেলে চাকরিপ্রর্থী উত্তরাধিকারীর সংখ্যা ২৮২। এর মধ্যে শ’দুয়েক ইতিমধ্যে জমির দাম ও ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়েছেন। বাকি রয়েছেন ৮০-৮২ জন।
মাহিনগরে জমি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আজিমগঞ্জ রেলযাত্রী সমিতির অন্যতম কর্তা মিলন রায় বলেন, ‘‘২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাজ্য, রেল ও জমি মালিকদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুসারে, রেলকে পুরো ৭ একর জমি হস্তান্তর করার পরে জমির মালিকদের রেল চাকরি দেবে। তার ফলে শতকরা ৭৫ ভাগ মালিক জমি হস্তান্তর করে। বাকি ২৫ ভাগ মালিক আগে চাকরি না দিলে জমি ছাড়বে না বলে বেঁকে বসে। সেই জটে আটকে থাকা সামান্য জমির জন্য বহু সাধের রেলসেতু প্রকল্প এখন বিশ বাঁও জলে।’’
১৯৯৫ সালে এই সেতুটির কথা মাথায় এসেছিল অবসরপ্রাপ্ত সেনা জওয়ান এ আর খানের। ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে শিয়ালদহ বিভাগের কৃষ্ণনগর-লালগোলা শাখা ও পশ্চিম পাড়ে হাওড়া বিভাগের কাটোয়া আজিমগঞ্জ শাখার রেলপথ সমান্ত রাল ভাবে উত্তর-দক্ষিণে চলে গিয়েছে। পুব দিকের নশিপুর হল্ট ও পশ্চিমের আজিমগঞ্জ জংশনের মাঝে ভাগীরথীর বুকে ভাঙা সেতুর দু’টো স্তম্ভ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে বহু দিন। সে সময়ে লালগোলার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের নিরাপত্তা কর্মীর কাজ করেন এ আর খান। ঘটনাচক্রে, রেলযাত্রী সমিতির সম্পাদকও তিনি। খান সাহেব বলেন, ‘‘বহু খোঁজাখুঁজির পরে রেলের একটি মানচিত্র থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নদীর দু’পারের দু’টি রেলপথ সংযুক্ত করেছিল ওই রেলসেতু।’’
বিষয়টি নজরে আসার পর থেকেই শুরু হয় লাগাতার আন্দোলন। রেলযাত্রী ও ব্যবসায়ী সমিতির যৌথ আন্দোলন তো ছিলই। পরে ডাম-বাম নির্বিশেষ সব রাজনৈতিক দল ওই রেলসেতুর দাবিতে সোচ্চার হয়। তার পিছনে রয়েছে মূলত অর্থনৈতিক কারণ। ‘সিটি মুর্শিদাবাদ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি’র সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘প্রস্তাবিত নশিপুর-আজিমগঞ্জ রেলসেতু নদীর দু’পারের রেলের দু’টি বিভাগের সংযুক্তিকরণের পাশাপাশি রেলপথে কলকাতা বা শিয়ালদহ থেকে উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের দুরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। দিল্লিগামী ট্রেন ধরতে মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার যাত্রীদের কলকাতায় ছুটতে হবে না।’’
রাজ্যের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও যোগাযোগের অভাবে মুর্শিদাবাদে পর্যটন শিল্পের বিকাশ বহু দিন ধরেই থমকে রয়েছে। সেই সব মাথায় রেখেই ২০০৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর ওই রেলসেতুর শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। স্বপনবাবুর দাবি, ‘‘শিলান্যাস অনুষ্ঠানে দুই মন্ত্রীই জানিয়েছিলেন, চার বছরের মধ্যে নশিপুর-আজিমগঞ্জ রেলসেতু দিয়ে ট্রেন ছুটবে। ১২ বছরেও প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় জনস্বার্থের মামলা করতে বাধ্য হলাম।’’
মামলাটা অবশ্য বড় কথা নয়। যে ভাবে হোক জট ছাড়িয়ে সেতু চালু করাই এখন তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য।