সহজ তদন্তেও কেন সিবিআই

কতটুকুই বা সময় পেলাম, বলছেন সিআইডি কর্তারা

১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাস। পুরুলিয়ায় বিমান থেকে অস্ত্রবর্ষণের ঘটনার পরে তদন্ত চালাচ্ছিল রাজ্য পুলিশ। কিন্তু তদন্ত এগোতেই মিলতে থাকে গোটা ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের ইঙ্গিত। অস্ত্রবর্ষণ মামলার তদন্তভার চেয়ে নিজেই এগিয়ে আসে সিবিআই। রাজ্য সরকারের মুখ্যসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে মামলার গুরুত্ব বোঝায় তারা। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বাসভবনে বৈঠক বসে রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের। তাঁদের মুখে সব শুনে জ্যোতিবাবু তৎক্ষণাৎ বলে দেন, “এই তদন্ত তোমরা চালাতে পারবে না। সিবিআই-কে দিয়ে দাও।”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৫ ০৩:২১
Share:

দল বেঁধে...। কলেজ স্ট্রিট থেকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত এ ভাবেই মিছিল করল পনেরোটি নারী সংগঠন। বৃহস্পতিবার। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাস। পুরুলিয়ায় বিমান থেকে অস্ত্রবর্ষণের ঘটনার পরে তদন্ত চালাচ্ছিল রাজ্য পুলিশ। কিন্তু তদন্ত এগোতেই মিলতে থাকে গোটা ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের ইঙ্গিত। অস্ত্রবর্ষণ মামলার তদন্তভার চেয়ে নিজেই এগিয়ে আসে সিবিআই। রাজ্য সরকারের মুখ্যসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে মামলার গুরুত্ব বোঝায় তারা। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বাসভবনে বৈঠক বসে রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের। তাঁদের মুখে সব শুনে জ্যোতিবাবু তৎক্ষণাৎ বলে দেন, “এই তদন্ত তোমরা চালাতে পারবে না। সিবিআই-কে দিয়ে দাও।”

Advertisement

একই গুরুত্ব সারদা কেলেঙ্কারির। জটিল আর্থিক বিষয়ক এই মামলার জাল ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক রাজ্যে। এ রাজ্যে অভিযুক্ত একাধিক মন্ত্রী এবং শাসক দলের নেতা। অন্য রাজ্যেও উঠে এসেছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের নাম। বিভিন্ন মহলে দাবি ওঠা সত্ত্বেও এহেন সংবেদনশীল মামলা সিবিআইয়ের হাতে দিতে চায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত শীর্ষ আদালতের নির্দেশে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র খুঁজে বার করতে সারদা মামলা হাতে নেয় সিবিআই।

সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্ত নিয়ে বেঁকে বসা, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে লাগাতার বিষোদ্গার করা মুখ্যমন্ত্রীই বুধবার রানাঘাটের কনভেন্ট স্কুলে ডাকাতি ও বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণের তদন্তের জন্য সিবিআই-কে অনুরোধ করেছেন। যে অনুরোধ মেনে আগামিকাল, শনিবার রাজ্যে আসছে সিবিআইয়ের তদন্তকারী দল। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ব্যাপারটা মাছি মারতে তোপ দাগা হয়ে গেল না কি? রাজ্যের পুলিশকর্তাদেরই একটা বড় অংশ বলছেন, অপরাধের গুরুত্ব যা-ই হোক না কেন, এই মামলায় বিশেষ কোনও জটিলতা নেই। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে চার দুষ্কৃতীর স্পষ্ট ছবি মিলেছে। ছবি আঁকা গিয়েছে আরও তিন দুষ্কৃতীর। ফলে তদন্ত প্রাথমিক ভাবে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। সাত দুষ্কৃতীকে ধরাই এখন মূল কাজ। দুষ্কৃতীদের ধরা গেলে বাকি রহস্যভেদ করার জন্য ফেলু মিত্তির বা ব্যোমকেশ বক্সীর প্রয়োজন হবে না।

Advertisement

সিবিআইয়ের এক কর্তাও এ দিন বলেন, “কী ধরনের অপরাধ হয়েছে, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এক, ডাকাতি এবং দুই, ধর্ষণ। ফলে, নতুন করে তদন্তের কোনও অবকাশ নেই। সিসিটিভি ফুটেজে দুষ্কৃতীদের ছবি উঠেছে। শুধু তাদের খুঁজে বার করাটাই এখন মূল কাজ।” পলাতক দুষ্কৃতীদের ধরার কাজটা কেন সিআইডি করতে পারবে না, কেন সিবিআই-কে দরকার হবে, এই প্রশ্নটাই তুলেছেন পুলিশকর্তারা। তাঁদের কথায়, “রানাঘাট-কাণ্ড আর যা-ই হোক নন্দীগ্রাম, ছোট আঙারিয়া বা জ্ঞানেশ্বরী রেল দুর্ঘটনার মতো তো কোনও ঘটনা নয় যে ষড়যন্ত্রের জাল ফাঁস করতে সিবিআই-কে তলব করতে হবে। এ বার তো তা হলে পকেটমার ধরতেও সিবিআই ডাকবে রাজ্য! সিআইডি-কে রাখার আর দরকার কী!”

সিবিআই অফিসারদেরও বক্তব্য, এই ধরনের অপরাধীদের ধরার কাজটা স্থানীয় পুলিশের পক্ষেই সহজে করা সম্ভব। কারণ, স্থানীয় দুষ্কৃতীদের সম্পর্কে তারাই অনেক বেশি খোঁজখবর রাখে। কোনও রাজ্যের এই সব অতি সাধারণ ডাকাত-ধর্ষকদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখার প্রয়োজন কোনও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থারই হয় না। তাই রাজ্য পুলিশ যে কাজটি সহজে করতে পারত, তা অকারণে সিবিআইয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে বিষয়টি জটিল করা হচ্ছে বলেই সিবিআই কর্তারা মনে করছেন।

কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের প্রশ্ন, “সিআইডি-র উপর থেকে তা হলে কি ভরসা উঠে গেল সরকারের?” আর রাজ্যের প্রাক্তন ডিজি এবং সিবিআইয়ের প্রাক্তন ডিরেক্টর অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “খুব দুঃখ লাগছে আজ সিআইডি-র এই হাল দেখে। আমাদের সময়ে সিআইডি-র উপরে কত ভরসা থাকত। এখন পুলিশ স্তাবকতায় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেন পারবে না সিআইডি? সিবিআই কি ম্যাজিক জানে নাকি!”

১৩ মার্চ গভীর রাতে রানাঘাটের স্কুলে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার পরের দিন ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছিলেন ক্ষুব্ধ স্থানীয় মানুষ। পুলিশ তাঁদের আশ্বাস দেয়, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে। চার দিন পরেও কেউ গ্রেফতার না-হওয়ায় গত সোমবার রানাঘাটে গিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়। তার পরেও আরও তিন দিন কেটে গিয়েছে। দুষ্কৃতীরা এখনও অধরা। এই অবস্থায় তদন্তের ভার সিবিআই-কে দিয়ে রাজ্য পুলিশের ব্যর্থতার কথা মুখ্যমন্ত্রী কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন বলে অনেকের মত। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা এটাও বলছেন যে, এই ব্যর্থতার দায় পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর উপরেই বর্তায়। তাঁর আমলে পুলিশ অপরাধী ধরার চেয়ে অপরাধ ধামাচাপা দিতেই বেশি ব্যস্ত। পুলিশ যত শাসক দলের অঙ্গুলিহেলনে চলেছে, ততই তাদের দক্ষতা কমেছে।

সিআইডি সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, একটা অপরাধের কিনারা করার জন্য ন্যূনতম যত সময় দরকার, সেটাই তাঁরা পাননি। সিআইডি-র এডিজি রাজীবকুমার সবেমাত্র রানাঘাটে ক্যাম্প অফিস করে তদন্ত পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছিলেন। নদিয়া জেলা সিআইডি এবং ভবানী ভবনের অফিসারদের নিয়ে চারটি দলও তৈরি করেছিলেন। উত্তেজিত জনতা যত শীঘ্র ফল আশা করে, তত তাড়াতাড়ি অপরাধীদের পাকড়াও করা সব সময় সম্ভব না-ও হতে পারে। তা ছাড়া, রানাঘাটের ঘটনার পরে এক সপ্তাহও পেরোয়নি। এত তাড়াতাড়ি তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার কোনও কারণ ছিল না। সিবিআই কর্তারাও একে কার্যত বিরল ঘটনা বলেই আখ্যা দিচ্ছেন।

আর তার জেরেই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতেই সিবিআই-কে ডাকলেন মমতা? বিরোধীদের অভিযোগ, গত চার বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার নজির তিনি পদে পদেই রেখেছেন। যেমন, ভোটব্যাঙ্ক হারানোর ভয়ে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের দায় তিনি ঝেড়ে ফেলেছেন নিজের সরকারের কাঁধ থেকে। এ বার ডাকাতি-ধর্ষণের তদন্তেও পলায়নীবৃত্তির পরিচয় দিলেন তিনি। যা দেখে বিরোধীরা বলছেন, সার্বিক এক কর্মবিমুখতাই গ্রাস করছে রাজ্যকে।

মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য রানাঘাটের ঘটনা ‘অতি গুরুতর ও স্পর্শকাতর’ এই যুক্তি দেখিয়েই সিবিআই তদন্তের কথা বলেছেন। তাঁর আরও বক্তব্য, ঘটনাস্থলের কাছেই বাংলাদেশ সীমান্ত। দুষ্কৃতীরা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে চলে গিয়ে থাকতে পারে। সে জন্যই সিবিআই তদন্তের প্রয়োজন। কিন্তু সিবিআই এবং সিআইডি-র কর্তারা বলেছেন, দুষ্কৃতীরা বাংলাদেশে চলে গিয়েছে, এটা তো একটা অনুমান মাত্র। তা ছাড়া, সেটা সত্যি হলেও তাদের ধরতে সিবিআইয়ের সাহায্য চাওয়াটাই যথেষ্ট ছিল। তাদের দিয়ে তদন্ত করানোর প্রয়োজন নেই। ভিন দেশ থেকে দুষ্কৃতী ধরার কাজে সাহায্য করবে ইন্টারপোল। সিবিআইয়ের অধিকর্তাই ভারতে ইন্টারপোলের নোডাল অফিসার। সিআইডি চাইলেই তাঁর সাহায্য পেত। সিবিআইয়ের এক কর্তা বলেন, “এ রাজ্যের সীমান্ত-লাগোয়া এলাকায় অনেক রকম অপরাধ করেই তো দুষ্কৃতীরা সীমান্ত পেরিয়ে পালায়। তা হলে মুর্শিদাবাদ থেকে উত্তর ২৪ পরগনা সমস্ত জেলায় সীমান্তবর্তী এলাকার সমস্ত অপরাধীদের ধরতেই কি এ বার থেকে রাজ্য সিবিআইয়ের শরণাপন্ন হবে?”

কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে এই ডাকাতি-ধর্ষণের পিছনে আরও বড় রহস্য জড়িয়ে। তাই কি সিবিআই তদন্ত দরকার? সিবিআই অফিসারদের যুক্তি, তার কিনারা তো তখনই হবে, যখন দুষ্কৃতীদের মধ্যে কেউ ধরা পড়বে। তাদের জেরা করে সেই কাজ তো সিআইডি-ই করতে পারত।

কাল আসছে দিল্লির দল

রানাঘাট ধর্ষণ তদন্তের দায়িত্বভার হাতে নিল সিবিআই। বুধবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রানাঘাট ধর্ষণ মামলাটি সিবিআইয়ের হাতে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটির সদর দফতর থেকে নবান্নে চিঠি পাঠিয়ে মামলাটি হাতে নেওয়ার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২১ মার্চ, শনিবার সিবিআইয়ের বিশেষ তদন্তকারী দল কলকাতায় আসছে। সে দিনই তাদের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাবে। এ ছাড়া নবান্ন ও রাজ্য পুলিশের সদর দফতর ভবানী ভবনে গিয়ে মামলার অগ্রগতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র দফতর এবং সিআইডি অফিসারদের সঙ্গেও কথা বলবেন তদন্তকারীরা। নবান্ন সূত্রের খবর, রানাঘাট ধর্ষণ কাণ্ডের তদন্তে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক অফিসারের নেতৃত্বে বিশেষ দল তৈরি করেছে সিবিআই। পাশাপাশি তারা রাজ্য পুলিশেরও সাহায্য চেয়েছে।

স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, সারদা মামলার তদন্তে সিবিআইয়ের একটি বিশেষ দল ইতিমধ্যেই রাজ্যে রয়েছে। সল্টলেকে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রানাঘাট কাণ্ডের তদন্তে আসা দলটির জন্য সল্টলেক অথবা ব্যারাকপুরে ক্যাম্প অফিস করার কথা ভাবছে সরকার। সিবিআই তদন্তকারী দলকে গাড়ি, কম্পিউটার, অফিস-সহ প্রয়োজনীয় সব কিছুই দেওয়া হবে। নবান্নের এক কর্তা জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার সিবিআইয়ের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন