গোড়ায় প্রায় মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে পুলিশকর্তারা কেউ-কেউ বলছিলেন, “এ সব কিছু পাকা ছেলের কাজ।” রাজনৈতিক নেতারাও বলছিলেন, “ছাড়ুন তো। ফালতু গুজব। কান দিয়ে লাভ নেই।”
এখন সেই পুলিশেরই নাভিশ্বাস উঠেছে। নিরীহদের গণপিটুনি থেকে বাঁচাতে ছুটছে হচ্ছে এখান-সেখান। খুঁজতে হচ্ছে গুজবের উৎস।
এলাকায় জঙ্গি ঢুকেছে, ডাকাতেরা জড়ো হচ্ছে, শিশুচুরি ও মেয়েদের শ্লীলতাহানি করা হচ্ছে বলে কিছু দিন ধরে যে প্রচার চলছে ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপে, তার শুরুটা গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। বিশেষ করে কল্যাণী ও হরিণঘাটায় ফোন থেকে পোনে মোবাইলে মেসেজ ছুটলেও পুলিশ তখন গুরুত্ব দেয়নি। পরে সেই মৃদু বাতাসই ঝড়ের চেহারা নিয়েছে। গণপিটুনিতে মারা গিয়েছেন এক জন। নিগৃহীত বহু। জনতার হাত থেকে ভবঘুরে ও মানসিক ভারসাম্যহীনদের বাঁচাতে আশ্রয় দিতে হয়েছে থানায় বা হোমে।
এখন পুলিশ কী বলছে?
উর্দিধারীদের একাংশের দাবি, বহু সময় তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিতে গেলে হিতে বিপরীত হয়। তাই প্রথমে শুধু নজর রাখা হচ্ছিল। নদিয়ার পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া অবশ্য দাবি করছেন, “যখন যেমন পদক্ষেপ করার কথা, তা ঠিকই করা হয়েছে। তাই ১৮ জানুয়ারির পর থেকে এই জেলায় নতুন ঘটনাও ঘটেনি।”
পদক্ষেপ বলতে— ১) গুজব ছড়ানো ও গণপ্রহারের অভিযোগে জনা তিরিশ গ্রেফতার। ২) সোশ্যাল মিডিয়ায় পুলিশের পাল্টা প্রচার। ৩) বিভিন্ন এলাকায় পঞ্চায়েত প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক ও লিফলেট বিলি। ৪) বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়দের নিয়ে টহল। ৫) সংখ্যালঘুপ্রধান এলাকায় মসজিদের মাইক ও জলসা থেকে প্রচার। ৬) ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। ৭) থানার গাড়ি ছাড়াও আট-দশটি করে মোটরবাইকে টহল। ৮) আদিবাসীদের মোড়লদের সঙ্গে আলোচনা। ৯) থানার নম্বরের পাশাপাশি নিজেদের মোবাইল নম্বরও ছড়িয়ে দিচ্ছেন পুলিশকর্মীরা, যাতে দরকারে লোকে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে।
মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, ‘‘কয়েক মাস আগে যখন গুজব ছড়িয়েছিল, সেই সময়ে প্রতিটি থানা এলাকায় মাইকে প্রচার করা হয়, প্রতি পাড়ায় লিফলেটও ছড়ানো হয়। সে কারণেই নতুন করে আর গুজব ছড়াচ্ছে না মুর্শিদাবাদে। তবে প্রতিটি থানা সতর্ক রয়েছে।’’
এমনিতে এলাকার সব ব্যাপারে যাঁরা মাতব্বরি করেন, সেই নেতারা কী করছেন? দিগনগরের তৃণমূল নেতা ধনঞ্জয় ঘোষ বলেন, “প্রথমে বুঝতেই পারিনি, গুজব এই চেহারা নেবে। এর পিছনে অভিসন্ধি আছে।” আগে বোঝেননি জানিয়ে সিপিএমের ভালুকা-জোয়ানিয়া লোকাল কমিটির সম্পাদক প্রবীর মিত্রও বলেন, “তবে এখন দলের তরফে মানুষতে সচেতন করার চেষ্টা চলছে।”
যে ‘অভিসন্ধিমূলক’ অপপ্রচারের জন্য ঠারেঠোরে বিজেপির একাংশকে দায়ী করছেন তৃণমূল নেতারা, তারাও পাল্টা সরব। দলের নদিয়া জেলা মুখপাত্র সন্দীপ মজুমদার বলেন, ‘‘আমরাও বলতে পারি যে, সুদীপ-তাপস ধরা পড়তেই লোকের নজর ঘুরিয়ে দিতে তৃণমূল এ সব করছে। আসলে কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের লোক এর পিছনে আছে।’’
হাত ফস্কে তির বেরিয়েই গিয়েছে। এখন শুধু দোষারোপ আর ‘ম্যানেজ’ দেওয়ার খেলা।