গ্রামীণে তালা ঝুলিয়ে চালু সুপার

সরকারি হাসপাতালে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘটনা, সাম্প্রতিক কালে কম নয়। তা বলে, মুমূর্ষুকে বাঁচাতে অন্যের আমুল প্রাণনাশের নজির নেই। সাগরদিঘি সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালটি তৈরি হয়েছিল বছরখানেক আগেই।

Advertisement

বিমান হাজরা

সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩৬
Share:

ওষুধ নিতে লম্বা লাইন সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। —অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

সরকারি হাসপাতালে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘটনা, সাম্প্রতিক কালে কম নয়।

Advertisement

তা বলে, মুমূর্ষুকে বাঁচাতে অন্যের আমুল প্রাণনাশের নজির নেই।

সাগরদিঘি সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালটি তৈরি হয়েছিল বছরখানেক আগেই। গত ডিসেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধনও করে গিয়েছিলেন। তবে, নীল-সাদা ডুরে, ঢাউস বাড়িটা সকালে তিন ঘণ্টার বর্হিবিভাগের পরিষেবা নিয়েই পড়ে ছিল এ যাবৎ।

Advertisement

সেই নিভু নিভু হাসপাতালে প্রাণ ফেরাতে, শনিবার সকালে, লাগোয়া গ্রামীণ হাসপাতালে তালা ঝুলিয়ে— এক্স-রে মেশিন থেকে ওষুধপত্র এমনকী চিকিৎসক আর জনা তিরিশ রোগী এমনকী প্রসূতিদেরও তুলে আনা হল সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের চৌহদ্দিতে।

যা দেখে ওই হাসপাতালেরই এক চিকিৎসকের মন্তব্য, ‘‘এ তো এক জনের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে গিয়ে অন্যকে মেরে ফেলা!’’

সাগরদিঘির গ্রামীণ হাসপাতালটি তুলে দিয়ে সুপার স্পেশ্যালিটির প্রাণ ফেরানো নিয়ে অবশ্য কোনও রাখঢাক করছেন না ওই সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের সুপার দীপালি মন্ডল। তিনি বলেন, “এত দিন গ্রামীণ হাসপাতালের বর্হিবিভাগ চলত সুপার স্পেশালিটিতে। বৃহস্পতিবার থেকে গ্রামীণ হাসপাতালটিই তুলে দিয়ে অন্তর্বিভাগটাও তুলে নিয়ে আসা হয়েছে।’’

জেলার চিকিৎসক মহলে তো বটেই, রাতারাতি সাগরদিঘির চালু গ্রামীণ হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়ায় কপালে ভাঁজ পড়েছে বিরোধী থেকে শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের কপালেও। জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর মান রাখতে আর কত কি যে করবে প্রশাসন!’’ তৃণমূলের এক ব্লক নেতাও কবুল করছেন, ‘‘সব কিছুই যদি এমন হুড়োহুড়ি করে হয়, তা হলে মানুষ তার সঙ্গে পাল্লা দেবে কী করে!’’

গত ১৬ ডিসেম্বর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাগরদিঘিতে এসে ওই সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের উদ্বোধন করে জানিয়ে গিয়েছিলেন, গ্রামীণ হাসপাতালটি চালু রেখেই রেফার করা রোগীদের উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হবে সাকুল্যে দু’শো মিটার দুরের ওই সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। এর ফলে গ্রামীণ হাসপাতালে রোগীদের চাপও কমবে। রেফারের হ্যাপা সামলাতে হবে না জেলা হাসপাতালকেও।

এ দিন সাগরদিঘি গ্রামীণ হাসপাতালে তালা পড়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, এত দিন প্রায় বন্ধ থাকা সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের রমরমে অবস্থা!

লিফট চালু হয়নি। সিঁড়ি ভেঙেই রোগীদের অধিকাংশকেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালের চার তলায়। প্রসুতিদের ঠাঁই হয়েছে তিন তলার ওয়ার্ডে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগটিও সেই চার তলায়। কেন?

হাসপাতালের এক কর্মী বলছেন, ‘‘আপাতত জরুরি ভিত্তিতে সব করা হয়েছে। পরে সব ঠিক করা হবে।’’ তবে, এমন তাড়াহুড়োর কারণ অবশ্য বলতে পারেননি তিনি।

জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ৩০ শয্যার ওই গ্রামীণ হাসপাতালটিতে গড়ে ৭০ জন রোগী ভর্তি থাকতেন। গড়ে শ’তিনেক রোগীর চিকিৎসাও হত সেখানে। পাঁচ জন চিকিৎসক দিনরাত এক করেই কাজ করতেন।

তালা গ্রামীণ হাসপাতালে।

সন্তোষপুরের আলেয়া বিবি রবিবার ভর্তি হয়েছিলেন গ্রামীণ হাসপাতালে। ছেলে রমজান বলছেন , “গত সাঁঝে বলা হল, মাকে নিয়ে যেতে হবে ওই সুপার হাসপাতালে। আমি নিজেই হাঁফাতে হাঁফাতে মাকে কোলে করে চার তলায় তুললাম!’’

মাজা নিয়ে নড়তে পারেন না নাসেদা বিবি। গ্রামীণ হাসপাতালে মঙ্গলবার ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তাঁকেও কোনওক্রমে চারতলায় তুলেছেন স্বামী মতিন শেখ। তিনি বলেন, “বিনা পয়সায় ওষুধ পাওয়ার কথা। কিন্তু আগের দিনও ১২০ টাকার ওষুধ কিনেছি, শনিবার ১০০ টাকা করে দু’টো ইঞ্জেকশন।”

এ দিনই আবার, খেলা করতে করতে পোপাড়ার ছোট্ট ছেলে মিনহাজুলের কানে ঢুকে গেছে ময়দার গোটা। ছেলেকে নিয়ে বাবা এমদাদুল ইসলাম ছুটে এসেছিলেন গ্রামীণ হাসপাতালে। গেট বন্ধ দেখে জানতে পারেন,— সব উঠে গিয়েছে ‘সুপারে’। বলছেন, ‘‘শুনলাম চারতলায় নাকি জরুরি বিভাগ সিঁড়ি ভেঙে উঠে দেখি কোথায় কি? এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী জানিয়ে দিলেন আজ কিছু করা যাবে না।’’ অগত্যা বহরমপুর ছুটেছেন তিনি।

সাগরদিঘি ব্লকে চারটি গ্রামীণ হাসপাতাল ছিল। তিনটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আগেই। এ দিনের পরে ব্লকে আর কোনও গ্রামীণ হাসপাতালই রইল না। তা হলে?

তাঁদের পরিদর্শনের সময়ে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ‘ভুয়ো’ চিকিৎসক-শিক্ষকদের উপস্থিতি বন্ধ করতে দিন কয়েক আগে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে ঘোষণা করেছে ‘মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’ (এমসিআই)।

শিক্ষক-চিকিৎসকদের নিয়ে কিছু নতুন নিয়ম জারি করেছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৈরি এমসিআইয়ের ‘ওভারসাইট কমিটি’।

মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্ন, রাজ্যের সুপারস্পেশ্যালিটি হাপাতালগুলিকে বাঁচাতে সেখানেও একই ধরনের ‘ভুয়ো’ কারবার চলছে বলে বেশ কিছু দিন ধরেই অভিযোগ করছিল বিরোধীরা। এ দিন সেই সুরেই আমিনুল বলছেন, ‘‘তা হলে আর কি, এখন সাগরদিঘি মানেই সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, যেখানে চারতলা ঠেঙিয়ে জরুরি বিভাগে পৌঁছেও কোনও চিকিৎসা মেলে না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন