‘রাজ্যে শিশুশ্রম বন্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। জেলার শ্রম ও শিশু কল্যাণ দফতরগুলিকে সক্রিয় করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ পিংলার বাজি বিস্ফোরণে নিহত মুর্শিদাবাদের ৯টি পরিবারের হাতে সরকারের তরফে দু’লক্ষ টাকা সাহায্যের চেক দিতে সুতির গ্রামে গিয়ে এমনই মন্তব্য করেছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও উদ্বেগ গোপন না করে সুতির প্রকাশ্য সভায় ক্ষোভ উগড়ে বলেছিলেন, ‘‘শিশু শ্রমিক, নারী পাচার, বাল্যবিবাহ— সবেতেই রাজ্যের মধ্যে জেলা এক নম্বরে। আমরা যে ভাবে শিশুদের বঞ্চনা করছি, শিশুদের সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় থাকছি, অন্য কোনও দেশ হলে অনেক মা, বাবাকেই আজ জেলে থাকতে হত।’’ শিশু সুরক্ষা কমিশনের রাজ্য সভাপতি অশোকেন্দু সেনগুপ্তও এমন ঘটনা রাজ্যের লজ্জা বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে জেলা প্রশাসন ও রাজ্য সরকারকে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
এত সব আত্ম সমালোচনা ও আশ্বাসের এক মাস পরেও শিশু সুরক্ষা নিয়ে কার্যত হেলদোলই দেখা যায়নি কোনও পক্ষের।
শ্রম দফতর আছে, আছে শিশু কল্যাণ দফতর, তৈরি হয়েছে শিশু সুরক্ষা দফতরও। কিন্তু দফতর থাকলেও নেই সক্রিয়তা। জেলা শিশু সুরক্ষা দফতর অবশ্য আইন প্রয়োগের থেকে শিশুশ্রম বন্ধে জোর দিচ্ছেন জেলা জুড়ে সুনির্দিষ্ট ‘টিম ওয়ার্ক’ তৈরির উপরে। সেই টিম কবে তৈরি হবে তা নিশ্চিত নয়। যদিও জেলার শিশু সুরক্ষা আধিকারিক অর্জুন দত্ত বলেন, ‘‘গ্রাম সংসদের মতো নীচু স্তর থেকে সচেতনতা তৈরি করতে হবে মানুষের মধ্যে। গত বছরে ৭৪টি সেমিনার করা হয়েছিল। এ বছর ১০২টি সেমিনার করা হবে।’’
কিন্তু সেমিনার করে, ভাষণ দিয়ে যে শিশুশ্রম রোখা যাবে না সেটাও ভাল মতো জানেন দফতরের কর্তারা। অর্জুনবাবু জানান, ইতিমধ্যেই জেলার ২৬টি ব্লকে শিশু সুরক্ষা কমিটি গড়া হয়েছে। শুরু হয়েছে গ্রাম সংসদ পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ। জেলার প্রায় ৩১০০ গ্রাম সংসদের মধ্যে মাত্র ২২৫টিতে এ পর্যন্ত কমিটি গঠন করা গিয়েছে। বাকি ২৯০০ সংসদে ২ মাসের মধ্যে কমিটি গঠনের কাজ শেষ করা হবে। সেই কমিটিকে সক্রিয় করে তোলা হবে সর্বতোভাবে। তারাই গ্রামে গ্রামে রুখবে ‘শিশু শ্রম, নারী পাচার, বাল্য বিবাহ এবং স্কুলছুটের মতো কাজগুলিকে। প্রশাসন তাদের সব রকম সাহায্য করবে।’’ জেলায় শিশু সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে এই রকম এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার জেলা কো-অর্ডিনেটর জয়ন্ত চৌধুরী বলেন, ‘‘মুর্শিদাবাদে শিশুশ্রম, বাল্য বিবাহ ও নারী–শিশু পাচার বন্ধ করতে হলে তা করতে হবে গ্রামস্তর থেকে। ১২ জুন এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলাম আমরা।’’ তিনি জানান, সেখানে ঠিক হয়েছে, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে ১৫০০ গ্রাম সংসদে গ্রামস্তরে সে কমিটি গঠন শেষ করতে হবে। ৩০ অগস্টের মধ্যে তা শেষ করা হবে জেলার সব সংসদে। তা ছাড়া শুধু কমিটি গঠন করলেই তো হবে না, কমিটিকে সক্রিয় করতে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মঙ্গলবার (২৩ জুন ) এ নিয়ে রাজ্য কমিটির বৈঠক রয়েছ। সেখানে রাজ্যের একটি নির্দেশিকা পেলে কাজে সক্রিয়তা বাড়বে।
সিটুর জেলা সভাপতি আবুল হাসনাত খান বলছেন, ‘‘পিংলার ঘটনার পর দেড় মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এই দেড় মাসে শিশু সুরক্ষার ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি জেলার কোথাও। মন্ত্রী বলছেন কড়া পদক্ষেপের কথা। জেলা শাসক হা-হুতাশ করছেন। অথচ জেলা প্রশাসন শিশু সুরক্ষায় কার্যত নিষ্ক্রিয়।’’ আইএনটিইউসির বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক বাদশার আলি বলেন, ‘‘শিশু সুরক্ষায় গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকে নিয়ে এ ব্যাপারে স্থায়ী কর্মসূচী নিতে হবে। স্থানীয় সমাজসেবীদের যুক্ত করতে হবে গ্রাম পর্যায়ের কমিটিগুলিতে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এই দু’টি কাজেরই বড় অভাব। শুধু মাত্র আমলাদের উপর নির্ভর করে শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া যাবে না। আমলা নির্ভরতার জন্যই গ্রামস্তরে শিশু সুরক্ষা কমিটি গঠনে এত ঢিলেমি।’’