সাঁঝ-বাদলে ৫

মাজারে পৌঁছতেই মিলিয়ে গেল ছায়ারা

ডহর ধারে তেনারা আসেন মাঝ রাতে আর বিল পাড়ের মাঠে। সে এক নিভু নিভু আলো, রাতভর... হ্যারিকেনের আলো তেরছা করে পড়েছে, বাদল সাঁঝে এমন বৃষ্টি-ঘন গপ্পো শুনতে সেই মাঠ-পুকুর-খালপাড় ধরে হাঁটল আনন্দবাজার।বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। মেজগিন্নি চা আর চানাচুর দিয়ে গেলেন। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে মেজকর্তা শুরু করেন, ‘তখন আমি ছাত্র। পড়তে গিয়েছি হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজে। জানুয়ারির শীত। হাড়ের ভিতরটাও যেন কেঁপে উঠছে। রাস্তায় লোকজন নেই। কয়েকটা দোকান খোলা। কিন্তু সেখানেও ক্রেতা নেই।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৭ ০৮:৩০
Share:

রংচটা দেওয়ালে মোষের মাথা। পাশেই ঢাল-তলোয়ার। তার পাশে বল্লম। কৃষ্ণনগরে পুরনো জমিদারবাড়ির আনাচকানাচে ঘোরাফেরা করে হাজার গল্প।

Advertisement

বাইরে প্রবল বৃষ্টি। বিদ্যুতের আলোও যেন বাড়ির সবটুকু ছুঁয়ে যেতে ভয় পায়। বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে আসে নূপুরের শব্দ। গা ছমছম করে। তবু গপ্পের টানে সে বাড়িতে চলে আসেন অনেকেই। বাড়ির মেজ ছেলে সুবীর সিংহ রায়ের মেজাজ ভাল থাকলেই খুলে বসেন গল্পের ঝাঁপি। বারান্দায় সেগুন কাঠের আরাম কেদারায় বসে তিনি। হাতে সিগারেট। অন্দরমহলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কই গো, একটু চা খাওয়াবে নাকি?’

সকলে নড়েচড়ে বসে। মেজকর্তা তা হলে মেজাজেই আছেন। রাস্তার ল্যাম্প পোস্ট থেকে তেরছা আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। সকলের মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। বেশ একটা আলো আঁধারি পরিবেশ। আচমকা চঞ্চল মাইকেল বলে বসেন, ‘কাকু আপনি ভূত দেখেছেন?’ মেজকর্তা শুধু এক বার হাসলেন। সে হাসি বড় রহস্যময়। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘‘হুম, ভূতের গপ্পো শুনতে চাইছিস তো? বেশ, তা হলে শোন।’

Advertisement

বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। মেজগিন্নি চা আর চানাচুর দিয়ে গেলেন। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে মেজকর্তা শুরু করেন, ‘তখন আমি ছাত্র। পড়তে গিয়েছি হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজে। জানুয়ারির শীত। হাড়ের ভিতরটাও যেন কেঁপে উঠছে। রাস্তায় লোকজন নেই। কয়েকটা দোকান খোলা। কিন্তু সেখানেও ক্রেতা নেই। আমরা জনাকয়েক সহপাঠী গুটি গুটি পায়ে হাজির। আমাদের সঙ্গেই পড়ত দামু। একটু রাত হলেই দামুর হাতে দোকান ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যেতেন তার বাবা। তারপরেই শুরু হত আমাদের আড্ডা। রাত গড়াত। আড্ডা যেন থামতেই চাইত না।’

ফস করে জ্বলে ওঠে দেশলাই কাঠি। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মেজকর্তা বলতে থাকেন, ‘সে দিন এত ঠান্ডা যে, কিছুতেই আড্ডা জমল না। সহপাঠীরা ফিরে গেল বাসায়। শেষ পর্যন্ত শুধু আমি আর দামু। দামুর বাড়ি পাশেই। সে চলে গেল। আমি বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। একা। পতাকা মোড় থেকে কিছু দূরে পণ্ডিতিয়া রোডে আমার বাসা। সুনসান রাস্তা। মাঝে ফাঁসি ময়দান। চারদিকে বিশাল আম বাগান। অনেকে বলেন, সেখানেই ইংরেজরা ফাঁসিতে ঝোলাত। সেখানে একটা কুয়ো ছিল। আমরা জানতাম, এই কুয়োর উপরেই ফাঁসি দেওয়া হত। বহু দিন যাতায়াতের পথে কুয়োটার দিকে তাকাতে তাকাতে গিয়েছি। কিন্তু রাতে সেই চেনা রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে যা হল! উফ্, ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।’

নড়েচড়ে বসে সকলে। গলাটা একটু ঝেড়ে তিনি আবার বলতে শুরু করেন, ‘গা ছমছম করছিল ঠিকই। কিন্তু যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। আচমকা একটা শব্দে সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে গেল। স্থির দাঁড়িয়ে রাস্তায় উপর। শরীরে এতটুকু শক্তি নেই। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। ওই কুয়োটার কাছে আসতেই হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ শব্দ। গাছের উপর থেকে ঠিক আমার পায়ের কাছে কী যেন একটা পড়ল ধপাস করে।’ সকলে বলে ওঠে, ‘কী পড়ল?’

কাঁচা পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে মেজকর্তা বলেন, ‘গাছের ডাল। কিন্তু ওই শব্দে আমার হৃদস্পন্দন যেন থমকে দিয়েছিল। এর পর জোরে পা চালাই। কিন্তু মনে হল তেনারা আমার পিছু পিছু হাঁটছেন। আমি থামলে তেনারাও থামেন। ঘাড়ের উপরে গরম নিঃশ্বাস অনুভব করি। এর পর আর কিছু না ভেবে সমস্ত শক্তি এক করে দৌড়তে শুরু করি। কিছুটা দূরে ফকিরবাবার মাজার। এলাকার মানুষের বিশ্বাস, ওই ফকিরবাবাই সবাইকে সব অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করেন। মাজারের কাছাকাছি পৌঁছতে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। বুঝলাম তেনারা আর নেই। এর পর মাজার থেকে নেমে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। পিছনে পড়ে থাকল ফকিরবাবার মাজার, বাগান, ফাঁসি-কুয়ো আর রাস্তার উপরে গাছের ভাঙা ডাল।’ সিগারেটটা ছাইদানিতে গুঁজে মেজকর্তা বললেন, ‘পরের দিনে সকালে কিন্তু গাছের শুকনো ডাল ভেঙে পড়ার কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ বাইরে কি ঝড় উঠল? (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন