সেতুর দাবিতে পড়ুয়াদের ক্ষোভ। কান্দির পুরন্দরপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
গায়ের উপর লেপ্টে রয়েছে ভেজা নীল-সাদা পোশাক। বৃষ্টি আর চোখের জলে একাকার হয়ে গিয়েছে লাল ওড়না। সপসপ করছে অঙ্ক খাতার পাতায় লাল কালিতে লেখা —‘অবিলম্বে সেতু করতে হবে’।
বুধবার দুপুরে অঝোর বৃষ্টিতে ওরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে বহরমপুর-কান্দি রাজ্য সড়কে। দু’দিকে সার দিয়ে বাস, ট্রাক, গাড়ি। টানা সাড়ে তিন ঘণ্টার অবরোধে কেউ বিরক্ত। কেউ উৎসাহী হয়ে গাড়ি থেকে নেমে জি়জ্ঞাসা করেছেন, ‘‘তোমরা কি সাইকেল পাওনি?’’ কেউ আবার বলেছেন, ‘‘সব ক্ষোভ রাস্তার উপরে কেন বাপু!’’
পুরন্দরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা কেউ রাগ করেনি। বরং বিনয়ের সঙ্গে বলেছে, ‘‘সেতু না থাকায় আমাদের এক সহপাঠী কাল ডুবে মারা গিয়েছে। জানেন, ও খুব কষ্ট পেয়েছে। আপনাদেরও ভোগান্তি হচ্ছে। তবে সেতু তৈরির আশ্বাস পেলেই আমরা অবরোধ তুলে নেব।’’
কেউ ওদের অবরোধের কথা বলেনি। কেউ ওদের উৎসাহও দেয়নি। কিন্তু সেতু না থাকার জন্য সহপাঠীর এমন মৃত্যুও ওরা মানতে পারেনি। তাই সহপাঠীর স্মৃতিতে নীরবতা পালনের পরেই স্কুল লাগোয়া ওই রাস্তায় নেমে এসেছিল ফাইভ থেকে টুয়েলভ সক্কলে। খবর পেয়ে ওদের সঙ্গে সামিল হয়েছিলেন অভিভাবকেরাও।
এ দিন সকাল থেকেই মুখ ভার ছিল আকাশের। চুপ মেরে ছিল কানা ময়ূরাক্ষী লাগোয়া হরিনারায়ণপুর। সেই পথ দিয়েই কান্না গিলে নৌকায় উঠেছিল ওরা। তারপর দড়ি টেনে টেনে মাঝ নদীতে আসতেই ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুক, ‘‘হ্যাঁ, ওই তো, ওইখানেই তো ভুস করে তলিয়ে গিয়েছিল জ্যোতি।’’ বুধবার তবুও ওরা স্কুলে গিয়েছিল জ্যোতির জন্যই। জ্যোতি কে ?
জ্যোতির্ময় সরকার। বয়স ১৫। বাড়ি হরিনারায়ণপুর। মঙ্গলবার বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কানা ময়ূরাক্ষীতে নৌকা ডুবে মারা গিয়েছে পুরন্দরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ওই ছাত্র। নৌকায় ৩৫ জন পড়ুয়া ছিল। ছিল দু’টো সাইকেল। অন্যরা কেউ সাঁতরে পাড়ে পৌঁছেছিল। কেউ আবার পেয়েছিল ভরসার হাত।
জ্যোতির্ময় পায়নি। সে সাঁতার জানত না। জলে পড়ে যাওয়ার পরে শরীরটা আটকে গিয়েছিল সাইকেলে। বেরোতে পারেনি সে। জল গিলে কোনও মতে খাবি খেয়েও সে হাতও উপরে তুলতে পারেনি। তাকেও দেখতে পায়নি কেউ। তারপর গহীন জলে একটু একটু করে অসাড় হয়ে যায় তার শরীর। যখন নীল-সাদা পোশাক পরা ছেলেটি ভেসে উঠেছিল ততক্ষণে সব শেষ।
ঘটনার পরে খড়গ্রামের বিডিও খুরশিদ আলম গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা। সেতু নির্মাণের ব্যাপারে বিডিও লিখিত আশ্বাস দেওয়ার পরেই শান্ত হন তাঁরা। এ দিনও অবরোধের খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছিলেন কান্দির বিডিও সুরজিৎ রায়। তিনি বলেন, ‘‘জেলাশাসকের সঙ্গে সেতুর ব্যাপারে কথা হয়েছে। আমরা অবিলম্বে ওখানে ফেরিঘাটের ব্যবস্থা করব। সেতুর ব্যাপারেও জেলাশাসক রাজ্যকে জানাবে।’’
তারপরেই অবরোধ তুলে নেয় পড়ুয়ারা। পড়ুয়া ও নদী পাড়ের বাসিন্দাদের দাবি, বছরভর ধু ধু করে কানাময়ূরাক্ষী। মাটি খুঁড়েও জল মেলে না। বর্ষা এলেই টইটম্বুর হয়ে যায় এই ‘কানা’ নদী। তখন খড়গ্রাম ধামালিপাড়া, হরিনারায়ণপুর, মনসবপুর, রায়পুর, কেশবপুরের মতো নদী লাগোয়া প্রায় দশটি গ্রামের বাসিন্দারা বিপাকে পড়েন। অন্য পথে যেতে হলে প্রায় ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। অগত্যা ভরসা সেই নদীপথ। অথচ সেখানে কোনও ফেরিঘাট নেই। নৌকায় মাঝি থাকেন বটে। তবে কোনও অঘটন ঘটলে কারও কিছু করার থাকে না। কারণ, প্রায় দেড়শো মিটার চওড়া ওই নদীতে দড়ি টেনে টেনে নৌকা বাইতে হয়।
মঙ্গলবার বিকেলে সে ভাবেই অন্য পড়ুয়াদের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল হরিনারায়ণপুরের জ্যোতির্ময়। তারপরেই মাঝ নদীতে এমন বিপত্তি। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘সেই কবে থেকে আমরা এখানে সেতুর দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু প্রশাসন সে কথা শুনলে কিছুতেই এমন ঘটনা ঘটত না।’’ পুরন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়-সহ লাগোয়া বহু স্কুলের পড়ুয়াদের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যেতে হয়। এ দিনও তারা সে ভাবেই এসেছিল। পুরন্দরপুর স্কুলের সহকারি প্রধানশিক্ষক সৈয়দ কাঞ্চন বলেন, “অবরোধ আমরা সমর্থন করি না। কিন্তু পড়ুয়ারা যে ভাবে স্বেচ্ছায় সেতুর দাবি নিয়ে পথে নামল, সত্যি কথা বলতে আমরাও বাধা দিতে পারিনি। কারণ সেতুটা প্রয়োজন। আমরা জ্যোতির্ময়ের মতো আর কাউকে হারাতে চাই না।’’ ছেলেমেয়েরা পথে নেমেছে শুনে হেঁশেল শিকেয় তুলে সন্তানদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন খাইরুন্নেসা বিবি, লুৎফা বিবি, শিখা মণ্ডলেরা। আপনারা কেন? কাকভেজা হয়ে তাঁরাও ছুড়ে দিয়েছেন পাল্টা প্রশ্ন—‘‘আরও কত মায়ের কোল খালি হলে সেতু বাঁধবে সরকার?’’