বৃষ্টিভাসি ব্যারাক স্কোয়ার ময়দান। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
টলটলে জলের উপর মোবাইল টাওয়ারের নিটোল ও প্রলম্বিত ছায়া। দূরে ঘন সবুজ ঘাস, গাছগাছালি। বিস্তীর্ণ সেই জলাভূমিতে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ছে দামাল ছেলেরা। আচমকা দেখলে বেমক্কা হোঁচট খেতে হয়— এ কোন দিঘি রে বাবা!
বৃষ্টির পরে জল থইথই বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ার ময়দান দেখলে এই ভ্রম যে খুব অস্বাভাবিক নয় সে কথা কবুল করছেন পুরসভা ও প্রশাসনের কর্তারা। কিন্তু মাঠের নিকাশির হাল ফেরানোর থেকেও তাঁরা বেশি ব্যস্ত পরস্পরের উপরে দায় চাপাতে। জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও বলছেন, ‘‘নিকাশির বিষয়টি পুরসভার দায়িত্বে রয়েছে। তবুও পুরসভার পক্ষ থেকে কোনও প্রস্তাব এলে বিবেচনা করে দেখা হবে।’’
আর পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলছেন, ‘‘এর আগে নানা ধরনের মেলা করায় ওই মাঠ নিচু ও অসমতল হয়ে গিয়েছে। সমতল না করা হলে মাঠ থেকে সব জল বের করা যাবে না। জেলা প্রশাসনকে ওই মাঠ সমতল করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে। নিকাশির বাকি কাজ পুরসভা করবে। প্রশাসন ও পুরসভা যৌথ ভাবে কাজ করলে সমস্যার সমাধান করা যাবে।’’
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে নবাব সিরাজের পরাজয়ের পরে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক ভরকেন্দ্র লালবাগ (মুর্শিদাবাদ) থেকে বহরমপুরে স্থানান্তরিত হয়। তার ৬ বছর পরে নবাব মির কাশিমের সঙ্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুদ্ধ হয়। বহরমপুরে সেনানিবাস গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনের ‘বোর্ড অব ডাইরেক্টর’। সেই মতো বহরমপুরে নবাব মির জাফরের দেওয়া ৪০০ বিঘা জমিতে ১৭৬৭ সালে গড়ে তোলা হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে প্রথম সেনানিবাস।
ওই সেনানিবাসের মাঝখানে ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৮৯৪ বর্গ কিলেমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয় ব্যারাক স্কোয়্যার ময়দান। বর্মা থেকে আমদানি করা রেনট্রি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় গোটা মাঠ। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরের লাটবাগানে সিপাহি বিদ্রোহ হয়। তারও মাস খানেক আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি সিপাহি বিদ্রোহের প্রথম স্ফূলিঙ্গ জ্বলেছিল ব্যারাক স্কোয়্যারে। এখনও তার স্মৃতিস্মারক আছে ব্যারাক স্কোয়্যার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে। ওই ময়দানের চার দিক ঘিরে থাকা সেনাছাউনি ও অফিসার আবাসন থেকে জল নেমে আসে ওই মাঠে। সেই জল নিকাশির জন্য ব্রিটিশরা তৈরি করেছিলেন ‘আন্ডার গ্রাউন্ড ড্রেন’। সংস্কারের অভাবে সেই ‘ড্রেন’ আজ অকেজো।
চারদিকে লোহার বেড়া, ফুলবাগান, হাইমাস্ট আলো, ত্রিফলা বাতি, বসার জায়গা ও ‘সাউন্ড সিস্টেম’-এর সাহয্যে সকাল সন্ধ্যা সঙ্গীতের ব্যবস্থা করে ব্যারাক স্কোয়্যারের শ্রী অনেকটাই ফিরিয়েছে বহরমপুর পুরসভা। মাস দুয়েক আগে অস্থায়ী হেলিপ্যাড স্টেডিয়ামে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। চারিদিকে ডজন খানেকেরও বেশি গেট বসিয়ে ওই মাঠে যানবাহন ও গবাদি পশুর প্রবেশ আটকে দিয়ে সবুজয়ানের ব্যবস্থা করেছে জেলা প্রশাসন। কিন্তু আড়াইশো বছর আগে ব্রিটিশদের তৈরি নিকাশি বেহাল হয়ে বৃষ্টি হলেই মাঠে জল জমে যায়। ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে ব্যারাক স্কোয়ার।
এই জলছবি কবে বদলাবে? সহজ প্রশ্ন। কিন্তু সদুত্তর নেই!