ফেরার গন্ধেই বেরোচ্ছে দাঁত-নখ

চাঁদা না দেওয়ায় মার টোটো চালককে

এত দিন তাঁরা একটু গুটিয়ে ছিলেন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বুথ ফেরত বা ভোট পরবর্তী সমীক্ষা দেখানোর পরে তাঁরা ফের স্বমূর্তি ধারণ করছেন। তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত টোটো চালকদের ইউনিয়নে নাম লেখাতে না চাওয়ায় এক চা‌লককে মারধর করে গাড়ি কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠল সংগঠনের এক নেতার বিরুদ্ধে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০১:৩০
Share:

জুলুমে, হুমকিতে বিরক্ত এঁদের অনেকেই। কৃষ্ণনগরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

এত দিন তাঁরা একটু গুটিয়ে ছিলেন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বুথ ফেরত বা ভোট পরবর্তী সমীক্ষা দেখানোর পরে তাঁরা ফের স্বমূর্তি ধারণ করছেন।

Advertisement

তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত টোটো চালকদের ইউনিয়নে নাম লেখাতে না চাওয়ায় এক চা‌লককে মারধর করে গাড়ি কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠল সংগঠনের এক নেতার বিরুদ্ধে। ওই টোটো চালক নদিয়ার পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন।

ঘটনাচক্রে, নদিয়ার ভোট হয়েছিল যে পর্বে, সেই চতুর্থ দফা থেকেই রাজ্যে জোটের হাওয়া তীব্র হতে শুরু করেছিল। ‘দলদাসত্ব’ ঝেড়ে ফেলে সক্রিয় হতে শুরু করে পুলিশও। যে প্রবণতা পরের তিনটি দফায় আরও স্পষ্ট হয়েছে। পুলিশ ও আধা সেনার পাহারায় ঢেলে ভোট দিয়েছে জনতা। ক্রমশ আরও বেশি তীব্র হয়েছে জোটমুখী হাওয়া।

Advertisement

আগের কোনও সমীক্ষায় ঈঙ্গিত না থাকলেও তৃণমূল সরকার পড়ে যাবে কি না, সেই প্রশ্ন এই পর্ব থেকেই উঠতে শুরু করেছে। এমনকী ভবানীপুরে তৃণমূল নেত্রী নিজে হেরে যাবেন কি না, সেই প্রশ্নও উঠছিল। স্বাভাবিক ভাবেই, শীর্ষ তৃণমূল নেতৃত্ব থেকে পাড়ায়-পাড়ায় উঠতি দাদা, সকলেই খানিক গুটিয়ে গিয়েছিলেন। যা হচ্ছিল, সবই তলায় তলায়, খানিক নিচু পর্দায়। কিন্তু সোমবার বিভিন্ন বুথ ফেরত বা ভোট পরবর্তী সমীক্ষায় তৃণমূলের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত বলে দেখানোর পরেই দাদাদের দাঁত-নখ আবার বেরোতে শুরু করেছে।

কৃষ্ণনগর পুরএলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মনসুর শেখ নানা জায়গা থেকে ঋণ করে টোটো কিনে শহরে চালাচ্ছিলেন। পুরসভার লাইসেন্সও আছে তাঁরা। কিন্তু তিনি তৃণমূলের ইউনিয়নের সদস্য নন। হতে রাজিও হননি। আর, সেটাই তাঁর উপরে কিছু দাদার রাগের কারণ। অনেক অনুনয় বিনয়ের পরও নেতাদের খপ্পর থেকে গাড়ি ফিরিয়ে আনতে না পেরে তিনি শেষ পর্যন্ত জেলার পুলিশ প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন।

কৃষ্ণনগর শহরের এই মুহূর্তে প্রায় বারোশো টোটো চলে। এর মধ্যে প্রায় আটশো গাড়ির লাইসেন্স দিয়েছে তৃণমূল পরিচাল‌িত পুরসভা। বাকি টোটোগুলি আশপাশের দোগাছি, ভাণ্ডারখোলা, ভাতজাংলা পঞ্চায়েত থেকে লাইসেন্স নিয়ে শহরের ভিতরে চলাচল করে। এর ভিতরে সিংহভাগ টোটো চালক আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত ‘কৃষ্ণনগর টোটো গাড়ি ড্রাইভার ইউনিয়ন’-এর সদস্য।

টোটো চালকদের একাংশের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরেই তৃণমূলের সংগঠনের সদস্যপদ নেওয়ার জন্য দাদারা তাঁদের চাপ দিচ্ছেন। সদস্যপদ নিলেও রক্ষা নেই। তার পরেও নানা অছিলায় তাঁদের থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। যাঁরা এ সব মানতে রাজি নন, তাঁদের উপরেই কোপ পড়ছে। মারধর করে গাড়ি আটকে রাখারও অভিযোগ রয়েছে।

মনসুর বলেন, ‘‘আমি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নই। তাই তৃণমূলের ইউনিয়নের সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইনি।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘ওই ইউনিয়নের নেতা তপন কুণ্ডু আমাকে তাঁদের ইউনিয়নে সদস্য হতে বলেছিলেন। আমি তাতে রাজি না হওয়ায় স্টেশনের কাছে খেজুরতলায় আমায় গাড়ি থেকে নামিয়ে প্রবল গালিগালাজ করতে করতে মারধর করেন ওঁরা। আর আমার কাছে থাকা ৬৪৫ টাকা কেড়েও নেন।’’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কিছু টোটো চালক অভিযোগ করেন, ইউনিয়নের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা রেহাই পাচ্ছেন না। নানা অছিলায় টাকা চেয়ে জুলুম করা হচ্ছে। আগামী বছর জানুয়ারিতে রক্তদান শিবির করা হবে জানিয়ে মাথাপিছু দু’শো টাকা করে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। স্টেশনে যাত্রী নামাতে গেলেও ইউনিয়ননের নাম করে মাসে তিনশো টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।

মুখেকিছু না বললেও অনেক টোটো চালকই এই জুলুমে বিরক্ত। মনসুর অবশ্য স্পষ্টই বলেন, ‘‘আমি এ সব টাকা দিতে চাইনি, এটাই আমার অপরাধ। আগামী জানুয়ারিতে রক্তদান শিবিরের জন্য কেন এখন থেকে চাঁদা দিতে হবে, সেই প্রশ্ন তুলেছিলাম।’’ তাঁর অভিযোগ, সেই ‘অপরাধে’ পিটিয়ে তাঁকে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাতেও যথেষ্ট শায়েন্তা করা হয়নি মনে করে তপন কুণ্ডু শক্তিনগর পাঁচমাথার মোড়ে তাঁর গাড়ি আটকে যাত্রীদের সামনেই নামিয়ে বেধড়ক মারধর করেন। গাড়িটিও কেড়ে নেন।

কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান অসীম সাহা এই সংগঠনের সভাপতি। মনসুরের অভিযোগ, এর পরেও ইউনিয়নে নাম না লেখালে প্রাণে মেরে ফেলা হবে বা অন্তত মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হবে বলেও তপন কুণ্ডু তাঁকে হুমকি দিয়েছেন। পুরপ্রধানকে বলে টোটোর লাইসেন্স বাতিল করিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। তপন অবশ্য রুটিন মেনেই দাবি করেন, ‘‘এই অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য আমরা কাউকেই জোর করি না। তার প্রয়োজনও নেই।’’

রক্তদান শিবিরের নামে এক বছর আগে থেকে টাকা তোলা হচ্ছে কেন?

তপনের ব্যাখ্যা, শুধু তো রক্তদান নয়, তাঁরা সাংগঠনিক সম্মেলন থেকে বস্ত্রদান, বহু কিছুই করেন। সদস্যদের উপরে যাতে এক বারে চাঁদা দেওয়ার চাপ না পড়ে, তার জন্য এখন থেকেই তোলা হচ্ছে। সেই সঙ্গেই তিনি যোগ করেন, ‘‘স্টেশনের স্ট্যান্ডটি ঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য আমরা দু’জন যুবককে রেখেছি। তাদের বেতনের জন্যও টাকা নিতে হয়।’’

কিন্তু কোনও টোটো চালক ইউনিয়নের সদস্য না হওয়ায় মারধর করে গাড়ি আটকে রাখবেন? তপনের দাবি, ‘‘এমনটা অন্তত আমার মনে পড়ছে না। যিনি বলছেন, তিনি কি প্রমাণ করতে পারবেন?’’

শুধু মনসুর শেখ নন, অভিযোগ করছেন কিন্তু অনেক টোটো চালকই। সংগঠনের নানা কাজের নাম করে জোর করে টাকা আদায় করা এবং তা দিতে না চাইলে হুমকি দিয়ে আদায়ের অভিযোগ একটু কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। ইউনিয়নের সভাপতি তথা পুরপ্রধান অসীম সাহা অবশ্য বলেন, ‘‘সংগঠনের সদস্য হওয়া-না হওয়ার সঙ্গে পুরসভার লাইসেন্সের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি অন্তত সেটা হতে দেব না।’’

পুরপ্রধানের আশ্বাস, ‘‘যদি কেউ এই ধরনের কাজ করে থাকেন, তা হলে আমি অন্তত সমর্থন করছি না। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে প্রযোজনীয় পদক্ষেপ করব।’’ পুলিশ সুপার শীষরাম ঝাঝারিয়া মঙ্গলবার বলেন, ‘‘এমন অভিযোগ এখনও আমার হাতে আসেনি। তা পেলেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

সমীক্ষা দেখেই যদি শাসক দলের কিছু দাদা ‘সাপের পাঁচ পা’ দেখে থাকেন, কাল যদি সমীক্ষা মিলে যায়, তখন তাঁরা কী করবেন— এই প্রশ্নই এখন ঘুরছে কৃষ্ণনগরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন