বদলে গেল মুলুক, হারাল পেশা

পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই ইস্রাইল শেখের এখনও মনে পড়ে, ‘‘শীত পড়তে না পড়তেই ঠাকুর্দা কাদের শেখ আর বাবা জামাল শেখের হাত ধরে বিহারের বেগুসরাই থেকে সটান বহরমপুরে চলে আসতাম।

Advertisement

অনল আবেদিন

বহরমপুর শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৮ ০১:২২
Share:

লেপ-সেলাই: বহরমপুরে। নিজস্ব চিত্র

যে পেশার টানে শৈশবে ‘দেশ’ ছেড়েছিলেন, সেই পেশাটাই হারিয়ে গিয়েছে।

Advertisement

পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই ইস্রাইল শেখের এখনও মনে পড়ে, ‘‘শীত পড়তে না পড়তেই ঠাকুর্দা কাদের শেখ আর বাবা জামাল শেখের হাত ধরে বিহারের বেগুসরাই থেকে সটান বহরমপুরে চলে আসতাম। বহরমপুরেই শীত কাটিয়ে বাবা ও দাদুর সঙ্গে বাড়ি ফিরতাম।’’ তাঁর হাতেখড়ি এ ভাবেই। তোশক, লেপ, বালিশ— শীতকালটা তাঁর যেন তুলোয় মোড়া থাকত!

বেশ কয়েক বছর পরিযায়ী পেশায় থাকার পরে তাঁরা লেপ, তোশক, বালিশ তৈরির টানে বেগুসরাইয়ের পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে উঠে এসেছিলেন বহরমপুর শহর লাগোয়া শেখপাড়া গ্রামে। কিন্তু পরিবার তো এল, হারিয়ে গেল সেই ধুনুরির পেশা।

Advertisement

ইস্রাইল একা নন, তাঁদের মতো আরও বেশ কয়েক ঘর ধুনুরি একই ভাবে দেশের পাট চুকিয়ে বহরমপুর লাগোয়া ভাকুড়ি ও শেখপাডায় বসতি গড়েছেন। ভাকুড়ির আলফাজ শেখ বলেন, ‘‘বিহার থেকে ভাকুড়িতে ঘর করে উঠে এসে বছর তিরিশেক থেকে পাকপাকি বাস করছি। কয়েক বছর আগেও শীতকালে নাওয়া খাওয়ার সময় জুটত না। কার বাড়িতে কবে লেপ, তোশক তৈরি করতে যেতে হবে, সেই তারিখ আগাম দেওয়ালে লিখে রাখতাম। তা ছাড়াও বিয়ে-শাদি উপলক্ষে সারা বছরই লেপ, তোশক তৈরির বায়না পড়ত। সেই দিন আজ আর নেই। এখন সব রেডিমেড।’’

সেই দিন যে নেই তা চোখে পড়ে, বহরমপুর শহরের মোহনের মোড়ে ইস্রাইল শেখের দোকান দেখে। সেখানে বস্তা বোঝাই তুলোর বদলে এখন থরে থরে সাজানো রয়েছে নামীদামি ‘ব্র্যান্ড’-এর কম্বল, তোশক ও বালিশ। আক্ষেপের সুরে ইস্রাইল বলেন, ‘‘জাত-পেশা খুইয়ে এখন আমাদের কম্বল বেচতে হচ্ছে!’’ খদ্দের এলে তাঁদের বোঝাতে হচ্ছে কম্বলের থেকে লেপ কেন এগিয়ে। লেপের আভিজাত্যের কথাও বলা হয়। তবুও খদ্দেরের টান কম্বলের দিকেই। এখন তাই কম্বলেই মুখ ঢেকেছেন তাঁরা।

আরও একটা কারণে বিহার ঝাড়খণ্ড থেকে শীতকালে পরিযায়ী শ্রমিকের ধুনুরিদের আসা কমে গিযেছে। পাকুড়ের ফুলবাস শেখ বলেন, ‘‘এখন লেপ, তোশক, বালিশ, বালাপোশ তৈরি করে যা মজুরি মেলে, তার দ্বিগুণ আয় হয় দিল্লি ও কেরলে দিনমজুরি করে।’’

প্রায় অবলুপ্তির পথে চলে যাওয়া এই পেশা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন ধুনুরিদের একাংশ। তাঁরা রিকশা ভ্যানের উপর একটি মেশিন বসিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দেন। সেই মেশিনে তুলো ধুনে লেপ তোশকের মতো শীত বস্ত্র তৈরি করছেন। ‘রেডিমেড’ কম্বলের সঙ্গে এই মেশিনের যুদ্ধ কিন্তু অসম যুদ্ধের শামিল। তবু বয়ে চলেছেন সেই পুরনো পেশা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন