রানাঘাটে পাকড়াও দুই, আজও অধরা কেন পার্ক স্ট্রিটের পাণ্ডা, প্রশ্ন পুলিশেই

ঘটনার ১২ দিনের মাথায় রানাঘাট-কাণ্ডের দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করল রাজ্যের পুলিশ। এবং সে জন্য সিবিআইয়ের সাহায্য প্রয়োজন হয়নি তাদের। যা দেখেশুনে এখন খোদ প্রশাসনের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্য পুলিশই যদি এই তদন্তে এত বড় পদক্ষেপ করতে পারে, তা হলে তিন বছর পরেও পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত কাদের খান পালিয়ে বেড়ায় কী ভাবে? তার নাগাল কেন পায় না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৫ ০৩:০৯
Share:

রানাঘাট আদালত থেকে ধৃত মহম্মদ সালিমকে নিয়ে বেরোচ্ছে সিআইডি। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

ঘটনার ১২ দিনের মাথায় রানাঘাট-কাণ্ডের দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করল রাজ্যের পুলিশ। এবং সে জন্য সিবিআইয়ের সাহায্য প্রয়োজন হয়নি তাদের। যা দেখেশুনে এখন খোদ প্রশাসনের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্য পুলিশই যদি এই তদন্তে এত বড় পদক্ষেপ করতে পারে, তা হলে তিন বছর পরেও পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত কাদের খান পালিয়ে বেড়ায় কী ভাবে? তার নাগাল কেন পায় না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ?

Advertisement

রানাঘাট-কাণ্ডে মুম্বইয়ের এক ঝোপড়পট্টি থেকে বুধবার রাতে সিআইডি গ্রেফতার করে মহম্মদ সালিম শেখকে। সালিম ও তার সাঙ্গোপাঙ্গকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে বৃহস্পতিবার হাবরার বাসিন্দা গোপাল সরকার নামে আরও এক জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সালিমকে ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে রানাঘাট আদালত। বাংলাদেশ থেকে আসা গোপালকে আজ, শুক্রবার আদালতে তোলা হবে।

রানাঘাট কাণ্ডে অপরাধীদের অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে যেতে পারে, এই আশঙ্কা মাথায় নিয়েই তদন্তে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছিল সিআইডি। একই সঙ্গে সোর্স নেটওয়ার্ক-এর মাধ্যমে খোঁজ শুরু হয় অপরাধীদের। যার ফল মিলল ১২ দিনের মাথায়।

Advertisement

এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, রানাঘাট কাণ্ডে এত কিছু করে অপরাধীদের জালে ফেলল যে পুলিশ, তারা তিন বছরের মধ্যে কেন কাদেরের টিকির সন্ধান পায়নি? পার্ক স্ট্রিটের নির্যাতিতা সুজেট জর্ডন সম্প্রতি মারা গিয়েছেন। কাদেরের খোঁজ কিন্তু সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। কেন?

প্রশাসনের একটি অংশ বলছে, রানাঘাটের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত দু’জনকে গ্রেফতার করা আর পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে কাদেরের ফস্কে যাওয়ার মধ্যে একটি বিশেষ তফাত আছে। তা হল রাজনীতির প্রভাব। রানাঘাট-কাণ্ডে রাজনীতির নামগন্ধ নেই। তাই রাজ্য সরকার সহজেই এর তদন্তে সিবিআই চাইতে পারে। কিন্তু কাদেরের সঙ্গে শাসক দলের একাংশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ইঙ্গিত ছিল বলেই প্রশাসনের ওই অংশের দাবি। কলকাতা পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, টলিউডের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে এক মন্ত্রীর খুবই ভাল সম্পর্ক। ওই অভিনেত্রী আবার কাদেরের বান্ধবী। সেই সূত্রে ওই মন্ত্রীর সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে কাদেরেরও। পুলিশের ওই অংশের অভিযোগ, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের তদন্তে নেমে তদন্তকারীরা যখন কাদেরের নাম জানতে পারেন, তখনই সক্রিয় হয়ে ওঠেন ওই মন্ত্রী। তাদের দাবি, তার জেরেই হাত গুটিয়ে নিতে হয় পুলিশকে। এবং অধরা থেকে

যায় কাদের।

পুলিশ দাবি করছে, কলকাতা থেকে পালানোর পরে কাদেরের প্রথম হদিস পাওয়া গিয়েছিল মুম্বইয়ে। তখন তাঁর অভিনেত্রী বান্ধবীও সঙ্গে ছিলেন। সেই খবর পাওয়ার পরেও পুলিশ দেরিতে পৌঁছনোয় কাদের ও তাঁর বান্ধবী মুম্বই থেকে গা ঢাকা দেন। যে হোটেলে ওই দু’জন উঠেছিলেন, তার রেজিস্টার বুক নিজেদের হেফাজতে নেয় পুলিশ। ব্যস, ওই পর্যন্তই। অভিযোগ, সেই বান্ধবীকে ধরেও কাদেরের কাছে পৌঁছনোর কোনও চেষ্টা করা হয়নি। বস্তুত এর পরে

আর কখনও কাদেরের কাছাকাছি পৌঁছতেই পারেনি কলকাতা পুলিশ। পুলিশের একটি অংশের দাবি, মুম্বই ছাড়ার পর একের পর এক সিমকার্ড বদল করছিল কাদের। তাতেই সে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

লালবাজারের কর্তারা এবং তৃণমূল অবশ্য মানতে চায়নি, এই ঘটনায় রাজনীতি কোনও প্রভাব ফেলেছে। বরং কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেছেন, “কাদেরের বিরুদ্ধে রেড কর্নার নোটিস জারি হওয়ার পর থেকে বিষয়টি ইন্টারপোলের বিচারাধীন। ইন্টারপোলই ওকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে। আমরা ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি।”

সালিমদের ধরার জন্য অবশ্য আটঘাট বেঁধে নেমেছিল সিআইডি। কী ভাবে ধরা পড়ল সালিম?

সিআইডি সূত্রের খবর, তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা প্রথমে নিজেদের ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’ কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে অপরাধীদের আস্তানা চিহ্নিত করা সম্ভব না হওয়ায় গোয়েন্দারা মোবাইল ফোনের উপরে নজরদারি করার একটি সফটওয়্যারের সাহায্য নেন। পুলিশ জানাচ্ছে, ওই সফটওয়্যারের পোশাকি নাম ‘টাওয়ার ডাম্প’। এতে একটি নির্দিষ্ট মোবাইল টাওয়ারে সারা দিনের কোন কোন সময়ে কোথা থেকে ফোন এসেছে বা ফোন গিয়েছে তা অনায়াসেই চিহ্নিত করা যায়। সেই আধুনিক প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করেই সিআইডি সামান্য হলেও আলোর সন্ধান পায়। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, মোবাইল টাওয়ারে নজরদারি শুরুর ক’দিনের মধ্যেই বেশ কিছু নম্বরের হদিস মেলে, যেগুলোকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়। এর পরে কেবল ওই নম্বরগুলির উপরে নজরদারি শুরু করে সিআইডি। আর তাতেই সাফল্য মেলে, দাবি তদন্তকারীদের একাংশের।

পাশাপাশি ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’-এর মাধ্যমে দুষ্কৃতীদের খোঁজখবর নেওয়া

বন্ধ করেনি সিআইডি। গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, গোপাল বছর দুয়েক আগে হাবরার গোহালহাটির উত্তরপাড়ায় বসবাস শুরু করেন। তার কোনও সচিত্র পরিচয়পত্র ও রেশন কার্ড নেই। গোপালের স্ত্রী অনিতা বাংলাদেশের খুলনার মণিরামপুর এলাকার বাসিন্দা। পুলিশ জেনেছে, রাজমিস্ত্রির পেশা ও দর্জিগিরির আড়ালে গোপাল মাদক পাচার করত। তার বাড়িতেও বসতো দুষ্কৃতী-আসর। এই খবর পাওয়ার পরেই গোপালের উপরে নজরদারি শুরু করেন গোয়েন্দারা। সিআইডি বলছে, মিলন নামে অনিতার এক মেসোমশাই মাঝেমধ্যেই গোপালের বাড়িতে এসে উঠতেন। তিনি আদতে বাংলাদেশের লোক। গোয়েন্দারা মনে করছেন, মিলনই এই দলটার পান্ডা। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে গোপালের স্ত্রী অনিতাকেও জেরা করছে পুলিশ।

পুলিশ বলছে, দিন ছয়েক আগে সূত্র মারফত জানা যায়, রানাঘাট-কাণ্ডের আগে গোপালের বাড়িতে বেশ কয়েক জন যুবক আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনার পর সকলেই উধাও হয়ে যায়। এতে সন্দেহ আরও জাঁকিয়ে বসে গোয়েন্দাদের। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সে দিনই গোপালকে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে জেরা করা হয়। সে-ই সালিমদের মোবাইল নম্বর দিয়ে দেয়। তদন্তকারীদের দাবি, গোপালের কাছ থেকে যে চারটি নম্বর পাওয়া যায়, সেগুলি ঘটনার পরেও বেশ কিছু দিন বন্ধ ছিল। তার মধ্যে একটি দিন দুয়েক আগে খুলতেই পুলিশের ছড়িয়ে রাখা প্রযুক্তি-জালে ধরা পড়ে যায় সালিম। দেখা যায় সেই ফোনটি এসেছে মুম্বই থেকে। পুলিশের অন্য একটি সূত্র জানাচ্ছে, মুম্বইয়ে যে সালিমের ডেরা রয়েছে, তা প্রথম দিনের জেরাতেই গোপাল জানিয়েছিল পুলিশকে। সেই তথ্য ধরেও এগিয়েছে সিআইডি।

গোয়েন্দা সূত্রের বক্তব্য, জেরায় সালিম জানিয়েছে, ওই রাতে তাদের একটা দল টাকা লুঠ করেছিল। অন্য দলটি বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ করেছিল। সালিম দাবি করেছে, সে টাকা লুঠে ছিল, ধর্ষণ করেনি। পুলিশ তার বক্তব্য মিলিয়ে দেখতে ফের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখেছে। তাতে পাঁচ জন দুষ্কৃতীকে টাকা লুঠ ও আলমারি ভাঙচুর করতে দেখা গিয়েছে। বাকি তিন জন সিসিটিভি-র আওতায় ছিল না। তারাই সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ করেছিল বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। তাই সালিমকে বৃহস্পতিবার সন্ধের পর থেকে ফের জেরা শুরু করেছে সিআইডি।

কেন ওই কনভেন্ট স্কুলে হানার ছক কষেছিল সালিমরা? ধৃতকে জেরা করে গোয়েন্দারা জেনেছেন, স্থানীয় দুষ্কৃতীদের কাছ থেকে সালিমরা জেনেছিল, স্কুলের অফিসের আলমারিতে টাকা রয়েছে। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে ঘটনার কিছু দিন আগে থেকে ওই এলাকায় ঘুরে ডাকাতির ছক পাকা করে তারা। স্কুলের আলমারিতে টাকা রাখার কথা কারা সালিমদের জানিয়েছিল, এখন সেটাই জানার চেষ্টা করছে সিআইডি। গোয়েন্দাদের একাংশের অনুমান, ভিতরের লোক সঙ্গে না থাকলে ওই নির্দিষ্ট তথ্য স্কুলের চৌহদ্দির বাইরে বেরোনোর কথা নয়। তার খোঁজে রয়েছেন গোয়েন্দারা। সালিম আরও জানিয়েছে, নেশার ঘোরে সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ করেছিল তার শাগরেদরা, যাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশি।

বৃহস্পতিবার ওই তথ্য জানিয়ে কেন্দ্রের সাহায্য চেয়েছে নবান্ন। কেন্দ্র অবশ্য এর মধ্যেই যোগাযোগ করেছে ঢাকার সঙ্গে। বাংলাদেশ সরকারও যথাসম্ভব সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক প্রথম থেকেই মনে করছিল, ধৃতদের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ রয়েছে। গোয়েন্দারা জেনেছেন, একাধিক অভিযুক্তের কাছে বৈধ পাসপোর্ট ছিল। ঘটনার পরে হইচই শুরু হওয়ায় তারা ওই পাসপোর্টের সাহায্যে বৈধ ভাবেই সীমান্ত পেরিয়ে যায়।

এই ঘটনায় রীতিমতো অবাক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাদের বক্তব্য, সাধারণত অবৈধ ভাবে এ দেশে ঢুকে অপরাধ করে বাংলাদেশের ফিরে যাওয়ার ঘটনাই বেশি ঘটে। যেমন ঘটেছিল খাগড়াগড়ে। কিন্তু রানাঘাটের ঘটনা বিরল। তবে কোন পথে অভিযুক্তেরা বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছে, তা নিয়ে মুখ খুলতে চায়নি কেন্দ্র-রাজ্য কোনও পক্ষই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন