সংরক্ষণের বাইরেও সাবলীল শান্তারা

ভোটের ময়দানে এই প্রথম নামলেন আলিয়ারা খাতুন বেওয়া। জঙ্গিপুর পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের এই কংগ্রেসের প্রার্থীর কাছে দল প্রথমে প্রস্তাব দিয়েছিল, মহিলা সংরক্ষিত যে কোনও আসনে দাঁড়াতে। আলিয়ারা সে পথে হাঁটেননি। তিনি বেছে নিয়েছেন প্রয়াত স্বামী মহম্মদ সামশুল ইসলামের ওয়ার্ডকেই। ‘‘স্বামীর কাছেই শিখেছি, রাজনীতিতে শর্টকাট বলে কিছু হয় না। মহিলা বলে নয়, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে লড়তে চাই। এবং অসংরক্ষিত এই আসন থেকেই জিতব।’’ বলছেন বছর সাতচল্লিশের আলিয়ারা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৪০
Share:

ভোটের প্রচারে বেরিয়েছেন জঙ্গিপুর পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী আলিয়ারা খাতুন বেওয়া। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।

ভোটের ময়দানে এই প্রথম নামলেন আলিয়ারা খাতুন বেওয়া। জঙ্গিপুর পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের এই কংগ্রেসের প্রার্থীর কাছে দল প্রথমে প্রস্তাব দিয়েছিল, মহিলা সংরক্ষিত যে কোনও আসনে দাঁড়াতে। আলিয়ারা সে পথে হাঁটেননি। তিনি বেছে নিয়েছেন প্রয়াত স্বামী মহম্মদ সামশুল ইসলামের ওয়ার্ডকেই। ‘‘স্বামীর কাছেই শিখেছি, রাজনীতিতে শর্টকাট বলে কিছু হয় না। মহিলা বলে নয়, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে লড়তে চাই। এবং অসংরক্ষিত এই আসন থেকেই জিতব।’’ বলছেন বছর সাতচল্লিশের আলিয়ারা।

Advertisement

ভোটের চেনা ছক ভেঙে রাজনীতিকেও বদলে দিচ্ছেন আলিয়ারার মতো মেয়েরা। মহিলা সংরক্ষিত আসন ছেড়ে ওঁরা লড়ছেন সাধারণ আসনে। পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। দল তাঁদের উপর আস্থা রেখেছে। জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তাঁরাও। আলিয়ারা জানালেন, সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কাউকে রেশন কার্ডের জন্য অফিসে নিয়ে যাওয়া, কারও উপর নির্যাতনের প্রতিকার চাইতে থানায় যাওয়ার মতো কাজ তিনি করেছেন। তারপর স্বামীর হাত ধরে রাজনীতিতে। সেই সময় এই ওয়ার্ডে জিতেই কংগ্রেসের কাউন্সিলর হয়েছিলেন মহম্মদ সামশুল ইসলাম। ২০০৭ সালে স্বামী মারা যান। কিন্তু রাজনীতি থেকে সরে আসেননি আলিয়ারা।

তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসারের পাশাপাশি এলাকায় সক্রিয় দলীয় কর্মী হিসাবে আলিয়ারা কাজ করছেন। বড় ছেলে সামিম আখতার বিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। মায়ের সঙ্গে তিনিও কখনও কখনও নির্বাচনী প্রচারে বেরোচ্ছেন। সামিম বলেন, ‘‘বাবার মতো মাকেও দেখছি দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করতে। মায়ের মতো মনের জোর যদি সব মহিলার থাকত তবে মহিলাদের জন্য আলাদা করে আসন সংরক্ষণের প্রয়োজন হত না। মায়ের জন্য আমি গর্বিত।’’

Advertisement

মনের জোর কম নেই জঙ্গিপুরের বধূ শান্তা সিংহেরও। বছর চল্লিশের শান্তাদেবী মনে করেন, আসন সংরক্ষণ করে মহিলাদের তেমন বিশেষ কোনও লাভ হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মহিলাদের সামনে রেখে পঞ্চায়েত কিংবা পুরসভায় কাজটা তো করেন তাঁদের স্বামীরা। তাই রাজনীতিতেও মহিলাদের স্বনির্ভর হওয়া জরুরি।

বহরমপুরের মেয়ে শান্তাদেবী ছাত্রজীবনে কখনও রাজনীতি করেননি। শ্বশুরবাড়িতেও কেউ কখনও রাজনীতির ধারেকাছে যাননি। সেই শান্তাই ২০০৫ সালে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কী ভাবে? ‘‘শ্বশুরবাড়িতে সিপিএমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আমার মাসতুতো দাদা, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী জঙ্গিপুরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মহিলা সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী হওয়ার জন্য উৎসাহ দেন। সেই শুরু।’’ বলছেন শান্তাদেবী। প্রথম নির্বাচনেই ৩১ ভোটে সিপিএম প্রার্থীকে হারিয়ে আনন্দে তিনি সারা রাত ঘুমোতে পারেননি। তারপর দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে আরও ১০টি বছর। ২০১০ সালে ওই ওয়ার্ডেই তিনি প্রার্থী ছিলেন। সে বার অবশ্য ওই আসল মহিলা সংরক্ষিত ছিল না। তবু তিনি ২৩৮ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। এ বারেও তিনি প্রার্থী সেই ৯ নম্বর আসনেই। এ বারও যা মহিলা সংরক্ষিত নয়।

কী করে সাধারণ আসনেও তিনিই দলের প্রার্থী হচ্ছেন? দলই বলছে, একার চেষ্টায় শান্তাদেবী নিজের আলাদা পরিচয় গড়ে তুলতে পেরেছেন। জঙ্গিপুরের রাজনীতিতে তিনি এখন রীতিমতো পরিচিত মুখ। দলের যে কোনও কর্মসূচি, সে আইন অমান্য হোক, কিংবা মিছিল-মিটিং, শান্তাদেবী থাকবেনই। এবং থাকেন তাঁর নিজের জোরেই, স্বামীর হাত ধরে নয়।

জঙ্গিপুর শহরে আইনজীবী হিসেবে পরিচিত মুখ ষাট ছুঁইছুঁই অনুরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় এসইউসির প্রথম সারির নেত্রী। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির শুরু। জঙ্গিপুর পুরসভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সংরক্ষিত আসনে দাঁড়িয়ে ১৯৯৫ সালে তিনি প্রথম বার কাউন্সিলর হয়েছিলেন। পরে সংরক্ষণ উঠে গেলেও, ওই আসন থেকে দাঁড়িয়ে ২০০০ সালেও নির্বাচিত হন তিনি। এ বারেও ১৯ নম্বর ওই সাধারণ আসন থেকেই প্রার্থী হয়েছেন তিনি। অনুরাধাদেবীর স্বামীও একই রাজনীতি করেন। কিন্তু রাজনীতিতে স্বামীর উপর নির্ভরশীল নন তিনি।

অনুরাধাদেবীও মনে করেন, আসন সংরক্ষণের উদ্দেশ্য মহিলাদের রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ও স্বনির্ভর করা। প্রশাসনিক কাজে আরও বেশি করে মহিলাদের যোগ দেওয়া জরুরি। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হয় কই? জঙ্গিপুর পুরসভাতে কাউন্সিলরদের সভাতেও স্বামীদের সঙ্গে নিয়েই মহিলা কাউন্সিলররা ঢোকেন। বহু বার সভায় এই নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। কিন্তু তা বন্ধ হয়নি। মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের আসল উদ্দেশ্য এখনও তাই সফল হয়নি।

শান্তিপুর পুরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের অসংরক্ষিত আসনে এ বার তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন রত্না ঘোষ। তৃণমূলের দাবি, বিগত পাঁচ বছরে রত্নাদেবী কাউন্সি‌লর হিসাবে এতটাই সফল যে স্থানীয় মানুষের দাবি মেনে তাঁকেই আবার প্রার্থী করা হয়েছে। একই ভাবে রানাঘাট পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে লড়ছেন তৃণমূল প্রার্থী তপতী বসু। মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও তাহেরপুর পুরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী করেছে উমা দত্তকে। উমাদেবী গত বারের জয়ী কাউন্সিলর। একদা মহিলা সংগঠনের জেলা সভানেত্রী উমাদেবীর জন্য আলাদা ভাবে কোনও সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন হয়নি বলেই দলীয় সূত্রে খবর। হরিণঘাটা ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী প্রতিমা সাঁতরা, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী বিউটি দাসও অসংরক্ষিত আসনে লড়ছেন।

এক সময় কল্যাণী পুরসভার সিপিএম কাউন্সিলর ছিলেন উত্তরা বারুরী। পরে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। এ বার কল্যাণী পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে উত্তরাদেবীকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। কারণ হিসাবে বিজেপির দাবি, কল্যাণী এলাকাকে হাতের তালুর মতো চেনেন উত্তরাদেবী। সেই সঙ্গে সংগঠনটাও ভাল বোঝেন। একই কারণে কল্যাণী পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে আরএসপি-র মানসী গঙ্গোপাধ্যায়, শান্তিপুর পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী সরস্বতী পাল হালদার ও রানাঘাট পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডে আরএসপি-র প্রার্থী করা হয়েছে করবী সেনকে। এর আগেও করবীদেবী পুরভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জয়ী হতে পারেন নি। তবুও এ বারেও দল তাঁকেই যোগ্য মনে করেছে।

নবদ্বীপ পুরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের প্রার্থী হয়েছেন জয়ন্তী কুণ্ডু হাজরা। ছাত্র জীবন থেকেই বাম রাজনীতি করা জয়ন্তীদেবী এলাকায় অত্যন্ত পরিচিত মুখ। এই ওয়ার্ডটি মহিলা সংরক্ষিত না হওয়া সত্ত্বেও জয়ন্তীদেবীকেই উপযুক্ত মনে করে দল তাঁকে টিকিট দিয়েছে। জয়ন্তী বলেন, ‘‘রাজনীতিতে আরও বেশি মহিলাদের এগিয়ে আসা উচিত। তাতে মহিলা সংরক্ষণের গুরুত্বটাও বাড়ে।’’

এ বঙ্গের ভোট-যাত্রায় হার-জিতের বাইরেও তাই অন্য রকম বার্তা দিচ্ছেন মেয়েরাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন