বাড়ির পুরুষ কর্মসূত্রে থাকেন ভিন্ রাজ্যে। তাঁর পাঠানো টাকা ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে গিয়ে তুলবেন, এমন ব্যবস্থায় ভরসা নেই স্ত্রী-র। অথচ, টাকাটা দরকার। এই অবস্থায় সরকারি পদ্ধতির বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘টিটি-সার্ভিস’। ‘টাকা ট্রান্সফার’ থেকে ‘টিটি’। আর মোটরবাইক চেপে লোকে সে টাকা বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে, তাই ‘সার্ভিস’।
ভিন রাজ্য থেকে ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন লোকের নামে খোলা সেভিংস অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকছে। কারা টাকা পাঠিয়েছেন, কাদের কাছে সে টাকা পৌঁছে দিতে হবে— সে তথ্য এসএমএসে চলে আসছে ‘টিটি’দের কাছে। পাঁচ-সাতটি ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে সে টাকা তুলে, গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতি হাজার টাকা পিছু ২৫ টাকা কমিশন পান ‘টিটি’রা।
এ ভাবে টাকা হাতবদল হওয়ার পদ্ধতি চালু হওয়ার জন্য এলাকায় সরকারি ব্যাঙ্কগুলির দিকে আঙুল তুলেছেন জেলাবাসী। তাঁদের দাবি, প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষিতের সংখ্যা কম। কিন্তু সরকারি ব্যাঙ্কের শাখায় অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে নানা রকম ফর্ম পূরণ করতে হয়। সে কাজে সাহায্য করতে নারাজ ব্যাঙ্ককর্মীদের একাংশ। আবার অ্যাকাউন্ট থেকে চেক কেটে বা এটিএম কার্ড ব্যবহার করে টাকা তুলতে গিয়েও অসুবিধায় পড়েন পড়াশোনা না জানা মানুষ। সে সব ‘ঝক্কি’ এড়াতেই এই বিকল্প পদ্ধতির শুরু।
স্থানীয় সূত্রের খবর, ‘টিটি সার্ভিস’ চালু হয়েছে বছর আটেক আগে থেকে। কে প্রচলন করেছেন জানা যায়নি। তবে আপাতত এই ‘পরিষেবা’র বিস্তার প্রায় গোটা জেলা জুড়েই। এক ‘টিটি’ জানাচ্ছেন, কাজের খোঁজে জেলা ছেড়ে ভিন রাজ্যে যাওয়া মানুষের সংখ্যা মুর্শিদাবাদে বেশি। সেই সুবাদেই এ জেলায় ওই ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত।
শুধু ডোমকল এলাকাতেই ‘টিটি’ রয়েছেন জনা সাতেক। এই ‘টিটি’দের মারফত বহু টাকার লেনদেন হচ্ছে খবর পেয়ে ইতিমধ্যেই জেলা পুলিশকে সতর্ক করেছে আয়কর দফতর। এসডিপিও (ডোমকল) অমরনাথ কে বলেন, ‘‘আমরা ব্যাপারটা নজরে রেখেছি। ব্যাঙ্কের স্থানীয় শাখাগুলিকেও এ ধরনের লেনদেনে জড়িতদের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।’’ সরকারি একটি ব্যাঙ্কের জলঙ্গির শাখা ম্যানেজার দাবি করেছেন, ব্যাঙ্কে লোকাভাবে অনেক সময় অ্যাকাউন্ট খোলার কাজ ব্যাহত হয়েছে। তবে এখন গ্রামে গ্রামে গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্র খুলে সমস্যা অনেকটাই মেটানো গিয়েছে।
যদিও প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা আলাদা। তাঁদের একটা বড় অংশ ভরসা রাখেন ‘টিটি’দের উপরে। কেন? ডোমকলের কুপিলা গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ারা বিবির দাবি, অ্যাকাউন্ট খুলতে ডোমকলের একটি সরকারি ব্যাঙ্কের শাখায় যেতে তাঁকে বলা হয়েছিল, ভাতশালায় যেতে। সেখানে গেলে, বলা হয় জলঙ্গি যেতে। আবার জলঙ্গির ব্যাঙ্ক ফেরত পাঠায় ডোমকলে। মনোয়ারার বক্তব্য, ‘‘আর ওই পথ মাড়াইনি। স্বামী টাকা পাঠালে ডোমকল থেকে টিটি বাড়িতেই টাকা দিয়ে যায়। এতে কিছুটা কমিশন কাটা যায়। কিন্তু গ্রাম থেকে জলঙ্গিতে ব্যাঙ্কে যাতায়াত করতেও তো খরচ হতো। তা ছাড়া, কোনও ঝঞ্ঝাটও নেই।’’
পুলিশ অবশ্য ভিন্নমত। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, সরকারি হিসেবে প্রায় চার লক্ষ বাসিন্দার ডোমকল মহকুমায় পড়াশোনা জানেন মাত্র ৫৫ শতাংশ। বাকি ৪৫ শতাংশের নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে এক সময় এলাকা থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলেছে বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থা। এলাকাবাসীর একটা বড় অংশের ব্যাঙ্কে যেতে অনীহা বা অস্বস্তি, সংখ্যালঘু মহিলাদের মধ্যে পর্দানসীন হয়ে থাকার প্রথা ছিল তাদের মূলধন। তার উপরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা সংগ্রহ বা ফেরত দেওয়ার রীতি ছিল অনেকের কাছেই বাড়তি আকর্ষণ। ২০১৩ সালের এপ্রিলে সারদা-কাণ্ডের আগেপিছে সে সব ভুঁইফোঁড় সংস্থা পাততাড়ি গুটিয়েছে। অনেক গরিব মানুষই টাকা খুইয়েছেন। কিন্তু ব্যাঙ্কমুখো হওয়ার প্রবণতা তাঁদের অনেকের মধ্যেই এখনও আসেনি।
ফলে থাকছে গণ্ডগোলের আশঙ্কা। মুখের কথা এবং বিশ্বাসের উপরে ‘টিটি সার্ভিস’ চললেও প্রতারণা যে হয়নি, এমনটা নয়। জেলা পুলিশের সূত্র জানাচ্ছে, সে সব অভিযোগ লিখিত আকারে থানা পর্যন্ত পৌঁছয় না। তার আগেই হাতে গোনা কয়েক জন মিলে সালিশি সভা বসিয়ে মীমাংসা করে ফেলে।
‘টিটি সার্ভিস’-এ জড়িত ডোমকলের এক বাসিন্দা জানাচ্ছেন, পড়শি বিভিন্ন রাজ্যে নির্দিষ্ট লোক রয়েছে তাঁদের। সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্য থেকে টাকাটা সেই লোকটিই তোলে। তার পরে হয় নিজের, না হয় কোনও এক ‘টিটি’র একাধিক আত্মীয়ের নামে খোলা অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়। কোনও শ্রমিক নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পাঠাতে না পারলে অসুবিধা নেই। সে সময়ে ‘টিটি সার্ভিস’-এর লোকজন পকেট থেকে টাকা দিয়ে থাকেন। পরে শ্রমিকের জমা দেওয়া টাকা থেকে কেটে নেওয়া হয় প্রায় দ্বিগুণ কমিশন। টাকা ঠিক হাতে না পৌঁছলে, ভিন রাজ্যের টাকা সংগ্রহকারীর উপরে চাপ দেন সংশ্লিষ্ট শ্রমিক। পারস্পরিক ‘বোঝাপড়া’র ভিত্তিতেই চলে লেনদেন।
বছর সাতেক ‘টিটি’ হিসেবে কাজ করছেন ডোমকলের শাহাবাজপুর এলাকার জিয়ারুল ইসলাম (নাম পরিবর্তিত)। জানাচ্ছেন, সংসারের অন্য কাজ সামলে শুধু সপ্তাহে দু’দিন বিকেলে এবং সন্ধ্যায় ‘সার্ভিস’-এর কাজ করেন। তাতে মাসে হাজার দু’য়েক টাকা আয় হয়। তাঁর যুক্তি, ‘‘ক্যুরিয়ার সার্ভিস তো কারও বাড়িতে টাকা পৌঁছে দেবে না। আমরা সে কাজটাই করি। এতে অন্যায় কী?’’
তবে চাহিদা অনুযায়ী সরকারি ব্যাঙ্কের পরিষেবা না পাওয়াটাই যে ‘টিটি সার্ভিস’-এর রমরমার কারণ, সে কথা স্পষ্ট হয়েছে অনেক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে। ডোমকলের বাসিরুল ইসলাম, সাদ্দাম হোসেনরা যেমন বলছেন, ‘‘মানুষ সরকারি দফতরের উপরে আস্থা রাখে, বিশ্বাস করে। সে পরিষেবা সহজে পেলে কেউ এ ভাবে টাকা পাঠানোর ঝুঁকি নিত না।’’