আজিমগঞ্জের চারবাংলা মন্দির। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?
ভাগীরথীর দু’ পাড়ের ঐতিহাসিক জোড়া শহর জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের প্রতি এমনই যেন মনোভাব পর্যটকদের। দু’ কিলোমিটার দূরে লালবাগের কাঠগোলার বাগান থেকে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে চলে যান। যমজ শহরে পযর্টকদের পা পড়ে না।
অথচ পর্যটনের সম্ভাবনা এ শহরে রয়েছে বিস্তর। জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জে জৈন সম্প্রদায়েরই ১৩টি সুদৃশ্য, বিশাল মন্দির রয়েছে। তার মধ্যে গুলজার বাগে আম, নারকেল, সুপারি গাছের বাগান আর পুকুর নিয়ে ৩২ বিঘা জমি জুড়ে রয়েছে শ্বেতপাথরের ‘দাদারস্তান’, বা পার্শ্বনাথের মন্দির। শিখ সম্প্রদায়ের গুরুদ্বারাতে রয়েছে গ্রন্থসাহেবের হাতে-লেখা পাণ্ডুলিপি। রয়েছে দুই পিরের মাজার, রামানুজ সম্প্রদায়ের দুটি আখড়া, খ্রিস্টানদের দু’টি চার্চ। রয়েছে নরোত্তম ঠাকুর ও তাঁর শিষ্য গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠিত ‘বড় গোবিন্দবাড়ি’, অর্থাৎ চৈতন্য অনুসারী গাম্ভীলা শ্রীপাট। সেখানেই নরোত্তম ঠাকুর ও গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তীর সঙ্গে শায়িত আছেন মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র। প্রয়াত রায়বাহাদুর সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহের দান করা জমিতে গড়ে উঠেছে ‘মুর্শিদাবাদ জেলা সংগ্রহশালা।’ তাঁরই সংগ্রহ করা নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর প্রস্তর মূর্তি আছে সেখানে। রয়েছে পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর পুরাতাত্ত্বিক নির্দশনও।
মুর্শিদাবাদের ইতিহাস উদ্ধারের উদ্দেশ্যে প্রায় সোয়াশো বছর আগে পায়ে হেঁটে গোটা জেলার দ্রষ্টব্য স্থান এবং স্থাপত্যের পরিচয় সংগ্রহ করেছিলেন ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়। তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনি’ বইটি থেকে জানা যায়, বাংলা ১১৫৩ সালে নাটোরের রাজা রামকান্ত মারা গেলে তাঁর বিধবা স্ত্রী রানি ভবানী জমিদারির হাল ধরেন। তাঁর জমিদারির রাজধানী ছিল আজিমগঞ্জ লাগোয়া ভাগীরথী পাড়ের বড়নগরে। বড়নগর তখন মুর্শিদাবাদ (লালবাগ) নগরীর অন্তর্ভূক্ত। রানি ভবানী বড়নগরকে ‘বাংলার বারানসী’ করে গড়ে তুলতে শতাধিক মন্দির নির্মাণ করেন। সংস্কারের অভাবে তার অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। টিকে আছে জোড়বাংলার গঙ্গেশ্বর, গোপালেশ্বর, রাজ রাজেশ্বরী, ভবানীশ্বর, চারবাংলা ও পঞ্চমুখির মতো কিছু মন্দির। চারবাংলা ও জোড়বাংলার মন্দিরের গায়ে আজও টিকে রয়েছে টেরাকোটা ও পোড়ামাটির অপূর্ব শিল্পকর্ম।
এখানে আসা-যাওয়াও কঠিন নয়। জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের বুক চিরে চলে গিয়েছে হাওড়া ও শিয়ালদহ বিভাগের দু’টি পৃথক রেললাইন। ছোট্ট পুরসভার মধ্যে রয়েছে তিনটি স্টেশন--- জিয়াগঞ্জ, আজিমগঞ্জ জংশন ও আজিমগঞ্জ সিটি। লালবাগের দিক থেকে জিয়াগঞ্জে প্রবেশপথ ঝা চকচকে। নিউ টাউনের মতো অত্যাধুনিক আলোক তোরণে সুসজ্জিত ওই আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ রাজপথে বসেছে ‘ক্যাটস আই।’ তবুও কেন পর্যটকের পা পড়ে না এখানে?
জিয়াগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমীর ঘোষ বলেন, “ভাল হোটেল নেই। অধিকাংশ রাস্তা ঝা চকচকে হলেও পুরসভার নিজস্ব স্থায়ী বাজার না থাকায় সব্জি বাজার বসে রাস্তা জবরদখল করে। লালবাগ পুরসভার সীমানা থেকে শুরু হয়েছে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভা। কিন্তু লালবাগের কাঠগোলার বাগান থেকে জিয়াগঞ্জে পৌঁছনোর জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। ফলে পর্যটকরা মাত্র ২ কিলোমিটার দূরের কাঠগোলার বাগান থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে।”
রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে থাকা বড়নগরের দোচালা জোড়বাংলা মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন স্থানীয় বাসিন্দা টুলটুলি মণ্ডল। পর্যটক টানতে সরকারি উদাসীনতার অভিযোগ করেন তিনিও। টুলটুলিদেবী বলেন, “জোড়বাংলা মন্দির থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে এসে থেমে গিয়েছে সৌরআলোর পথবাতি। সরকারি কর্তাদের মাস ছয়েক থেকে অনেক বার বলেও কোনও লাভ হয়নি।” তাঁর দাবি, এত অবহেলা সত্ত্বেও দেশ বিদেশ থেকে পর্যটক আসে।
পর্যটনের প্রয়োজনে ভাগীরথী পাড়ের সৌর্ন্দযায়ন করা জরুরি। পর্যটনের জন্য তেমনই জরুরি সরকারি প্রচার। সিপিএমের দখলে থাকা জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের পুরপ্রধান শঙ্কর মণ্ডল বলেন, “গঙ্গার পাড় লাগোয়া শহরের সৌন্দর্যায়নের জন্য কেন্দ্র বিভিন্ন পুরসভাকে অর্থ বরাদ্দ করে। ওই প্রকল্পে ২০১১ সালে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের জন্য কেন্দ্র ৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। রাজ্য সরকারের অসহযোগিতায় সেই টাকা আমরা পাইনি।” তাঁর দাবি, ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও প্রাচীন ধর্মস্থানের সুবাদে রাজ্যে পর্যটন মানচিত্রে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকলেও সরকারি প্রচারের অভাবে সেই সব তথ্য বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাতই রয়ে গিয়েছে। ফলে তার খারাপ প্রভাব পড়ছে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের পর্যটন শিল্পে।
তবে উন্নয়নের কাজে এলাকার মানুষেরও যথেষ্ট সহযোগিতা পাননি, আক্ষেপ শঙ্করবাবুর। তিনি জানান, ব্যক্তি মালিকানার গাম্ভীলা শ্রীপাট ও লাগোয়া (ট্রাস্টি মালিকানা) শিববাড়িতে রয়েছে অব্যবহৃত বিঘা চারেক জায়গা। আজিমগঞ্জে গঙ্গার ধারে রয়েছে ভূমি দফতরের সাড়ে ছয় বিঘা জমি। “গাম্ভীলা শ্রীপাঠ ও শিববাড়ির জমিতে পুরসভার পক্ষ থেকে বিনা ব্যয়ে বাজার গড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে অনেক বার। বলেছিলাম, মালিকানা অটুট থাকবে। তবুও সম্মতি মেলেনি।” পুরসভার নিজস্ব জমি না থাকায় বাজার নির্মাণের জন্য ভূমি দফতরের সাড়ে ৬ বিঘা জমি লিজ চেয়েও পাওয়া যায়নি, অভিযোগ করেন শঙ্করবাবু।
অতুলনীয় সম্পদ নিয়েও তাই জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ আজও পর্যটকের অপেক্ষায়।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’। অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১