সারাবছর এ ভাবেই জল জমে থাকে। নিজস্ব চিত্র
আজও ইতিহাস এখানে কথা বলে। বহরমপুরের এই ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ঘাসের আস্তরণে কান পাতলে শোনা যায় ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারির দেশীয় পদাতিক বাহিনীর ১৯তম রেজিমেন্টের বিদ্রোহের গর্জন। যা ব্যারাকপুরের লাটবাগানের সিপাহি বিদ্রোহেরও কিছু দিন আগের ঐতিহাসিক ঘটনা।
পালকি চড়ে ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের উপর দিয়ে চলেছেন তত্কালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘নেটিভ’-এর ওই ‘স্পর্ধা’ মানতে পারলেন না ইংরেজ সাহেব কর্নেল ডাফিন। তিনি অপমান করলেন সাহিত্য সম্রাটকে। বঙ্কিমও ছেড়ে কথা বলার পাত্র নন। সংঘাত গড়াল আদালত পর্যন্ত। অবশেষে বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি মেলে দৌর্দণ্ডপ্রতাপ কর্নেল সাহেবের।
মৃতপ্রায় ধূসর ঘাসের আস্তরণে আজও লেখা আছে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির জেলা নেতা সুধীন সেনের গাওয়া গানের তালে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ইতিহাস। তার ৩ দিন পরে, ১৮ অগস্ট মুর্শিদাবাদ জেলা ভারতভুক্ত হলে ফের সুধীন সেনের গাওয়া জাতীয় সংগীতের সুরের মুর্ছনায় এই মাঠেই তোলা হয় ভারতের জাতীয় পতাকা।
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ভবনের সঙ্গে ব্যারাক স্কোয়ার মাঠে পাকিস্তানের পতাকা উড়েছিল মোটে ৩ দিন। তার পর ১৮ অগস্ট সেই পতাকা নামিয়ে দিয়ে তোলা হয় ভারতের জাতীয় পতাকা। ব্যারাক স্কোয়ার মাঠ ঘিরে জন্ম নেওয়া সেই রোমহর্ষক ইতিহাস শোনালেন মুর্শিদাবাদ জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বিষাণ গুপ্ত। তিনি বলেন, “এ জেলার সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যান স্যার সিরিল জন র্যাডক্লিফের রায়ে মুর্শিদাবাদ চলে যায় পাকিস্তানের মধ্যে। পরিবর্তে ভারতের মধ্যে চলে আসে খুলনা। নানা প্রচেষ্টার ফলে ৩ দিন পরে, ১৯৪৭ সালের ১৮ অগস্ট মুর্শিদাবাদ ভারতভুক্ত হয়। পাকিস্তানভুক্ত হয় খুলনা।” ঐতিহাসিক ওই ঘটনার সূত্রে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ব্যারাক স্কোয়ার মাঠে তোলা হয় পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা। বিষাণবাবু বলেন, “সেই অনুষ্ঠানে কমিউনিস্ট নেতা সুধীন সেন তাঁর নিজের রচিত ও সুরারোপিত সংগীত, ‘সোনার দেশে গড়ব মোরা স্বাধীন পাকিস্তান/ সুখ শান্তি আনব মিলে হিন্দু মুসলমান...’ পরিবেশন করেন।” ফের ৩ দিন পর ব্যারাক স্কোয়ারের বুক থেকে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে নিয়ে সেখানে তোলা হয় ভারতের জাতীয় পতাকা। তখনও সুধীন সেন জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন।
এ হেন হাজারো ইতিহাস লালিত ব্যারাক স্কোয়ার মাঠ প্রশাসনিক উদাসীনতায় আজ ধ্বংসের মুখে। হেলিপ্যাড আর হাজারো মেলার দাপটে মাঠের সবুজ গালিচা এখন বিবর্ণ, মৃতপ্রায়। বর্ষায় হাঁটু জলে ডুবে থাকে প্রায় আড়াইশো বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক এই মাঠ। তখন শ্যাওলা পড়ে যাওয়ায় পিচ্ছিল মাঠ ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। অথচ একদা ব্যারাক স্কোয়ার এলাকা যে কোনও জাতির পক্ষে গর্বের সম্পদ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন নবাব ও ইংরেজ আমলের মুর্শিদাবাদের ইতিহাসবিদ গোলাম হুসেইন। মুর্শিদাবাদের ইতিহাস গবেষক বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘শহর বহরমপুর’ গ্রন্থে গোলাম হুসেইনের ‘সিয়ার-উল-মুতাক্ষরীন’ উদ্ধৃত করে লিখেছেন, “বহরমপুরের এই সব চেয়ে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর সেনানিবাসের জন্য যে কোনও জাতি গর্ব করতে পারে।” বেশিরভাগ সময় জলমগ্ন থাকা ওই এলাকাকে জাতির গর্বের সম্পদে উন্নীত করতে ১৭৬৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খরচ হয়েছিল ৩ লক্ষ ২ হাজার ২৭০ পাউন্ড। প্রথমে অবশ্য বহরমপুরে ব্যারাক করতে সম্মত ছিল না সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লন্ডনের পরিচালকমণ্ডলী। পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ পরাজিত ও নিহত। বাংলা বিহার ওড়িশা নিয়ে গঠিত সুবে বাংলার মসনদে তখন মির জাফর।
তাঁর কাছ থেকে বহরমপুর শহরে ৪০০ বিঘা জমির সনদ পেয়েছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এ দেশীয় পরিচালকমণ্ডলী। নবাবদের উপর নজর রাখার জন্য ওই জমিতে পঞ্চভূজ দুর্গ নিমানের জন্য কাশিমবাজার কুঠির ক্যাপ্টেন ব্রোহিয়ার একটি প্রস্তাব দেন পলাশির যুদ্ধের মাস তিনেক পর ১৭৫৭ সালের অক্টোবর মাসে। লন্ডনের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকমণ্ডলী ওই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি মন দিতে বলে। সেনানিবাস গড়ার প্রস্তাব প্রত্যাখানের বছর ছয়েক পর, ১৭৬৩ সালে বাংলার নবাব মির কাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধের পর লন্ডনের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকমণ্ডলী বহরমপুরে সেনানিবাস গড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। বহরমপুরের ব্যারাক তৈরির জন্য ১৯৬৫ সালে লন্ডন থেকে অনুমতি পৌঁছয় কাশিমবাজারে ইংরেজ কুঠিতে। ব্যারাক গড়তে নিয়োগ করা হয় প্রধান ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল এ ক্যাম্ববেলকে।
তাঁর তত্ত্বাবধানে ১ লক্ষ ৯৩ হাজার ৬০০ বর্গগজ আয়তনের একটি বর্গাকার মাঠের চার পাশে প্রশাসনিক ভবন, বাসভবন ও সেনা ব্যারাক তৈরি করা হয়। ওই মাঠটিই ব্যারাক স্কোয়ার ফিল্ড যার দৈর্ঘ ও প্রস্থ, অর্থাত্ প্রতিটি দিক ৪৪০ গজ দীর্ঘ। মাঠের চারপাশে লাগানো হয় রেনট্রি। বহরমপুর পুরসভার ১৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় বিশাল বপুর একটি গ্রন্থ। নাম ‘ইতিহাসের আলোকে বহরমপুর পৌরসভা (১৮৭৬-২০০৭)’। ওই গ্রন্থে ‘বহরমপুরে হারিয়ে যাওয়া সবুজ’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখেছেন কৃষ্ণনাথ কলেজের পদার্থবিদ্যার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক পূর্ণেন্দু সেন। তিনি লিখেছেন, “গাছগুলির আদি নিবাস সুদূর মধ্য আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইংরেজরাই এ গাছ আমাদের দেশে নিয়ে আসে। এপ্রিল মাসে ওই গাছে ছোট ছোট গোলাপি রঙের ফুল ফোটে। গাছগুলির আকার বিশাল। বাঁচেও অনেকদিন। বাংলাদেশের আবহাওয়া এদের বেশ পছন্দ। গাছগুলি তাদের ডালপালা দিয়ে এমন ভাবে রাস্তা ঢেকে থাকত যে প্রচণ্ড গরমেও লোকজনের চলাফেরা করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হত না। গাছগুলির কয়েকটি এখনও বেঁচে আছে। অনেকগুলিই নেই। ওরা মরেনি। ওদের মারা হয়েছে মবিল ও হিঙের জল গাছের গোড়ায় ঢেলে, ওদের গলা টিপে মারা হয়েছে। আমার আপশোস আজকালকার ছোট শিশুরা এটা দেখতে পেল না।”
আড়াইশো বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক ওই সব রেনট্রির মতো ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের চারপাশের আছে আন্ডার গ্রাউন্ড নিকাশি ব্যবস্থা। সংস্কার ও দেখভালের অভাবে সেই প্রাচীন ও অতি উত্তম নিকাশি ব্যবস্থা এখন প্রায় অকেজো। সেই নিকাশি ব্যবস্থারও বয়স ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের সমতুল। বহরমপুর শহরের বিখ্যাত প্রাক্তন ফুটবলার শ্যামাপদ দে’র বয়স প্রায় ৭৫ বছর। শ্যামাবাবু বলেন, “ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। মুষলধারে বৃষ্টি হলেও ব্যারাক স্কোয়ারে জল জমত না। এক ঘণ্টাতেই হাঁটু জল সাফ হয়ে যেত। এখন বর্ষাকালে সারাদিনেও মাঠ থেকে জল বের হয় না। খেলা বন্ধ রাখতে হয়।”
বহরমপুর শহরের ভূমিপুত্র কবি সমীরণ ঘোষের মতে, “শুধু শহরের মানুষের প্রয়োজন মেটায় না, ঐতিহাসিক ব্যারাক স্কোয়ার সারা জেলার সব ধরণের মানুষকে ধারণ করে থাকে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। ওই মাঠে সাহিত্যের আড্ডা বসে, পত্রিকা প্রকাশ হয়, বিভন্ন সংস্থার ২৫-৩০ জনের বৈঠক হয়। খুদে থেকে বৃদ্ধ, বালিকা থেকে থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত সবার প্রাতঃভ্রমণ থেকে সান্ধ্যভ্রমণের এটাই প্রিয় মাঠ। শরীরচর্চা, ভলিবল থেকে ব্যাডমিন্টন, ফুটবল থেকে ক্রিকেটেরও এটাই প্রিয় ময়দান।”
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ স্পোর্টস-এর সিনিয়র ফুটবল কোচ বহরমপুরের দুর্গাপ্রসন্ন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ভিভি আইপি-দের জন্য হেলিপ্যাড, বইমেলা, শিল্পমেলা, কৃষিমেলার মতো বহুবিধ আয়োজন করে মাঠের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ স্টেডিয়ামের পাশেই অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বিশাল এলাকা। সেখানেও তো এসব আয়োজন করা যেতে পারে। তাতে ব্যারাক স্কোয়ার মাঠ বাঁচে, মেলাখেলারও অসুবিধা হয় না।”
বহরমপুর পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, “ঐতিহাসিক ওই মাঠ আরও আকর্ষনীয় করে তুলতে মাঠের চারপাশ লোহার রেলিং দিয়ে ঘিরে দিয়ে সেখানে ফুলবাগান করে দেওয়া হয়েছে, চারপাশে লাগানো হয়েছে ত্রিফলা আলো। পূর্ণিমার আলোর মতো গোটা মাঠ আলোয় ভাসিয়ে দিতে চার কোনে বসানো হয়েছে ৫০ ফুট উচ্চতার ৪টি হাইমাস্ট বতিস্তম্ভ। শীতের শিশির ও গ্রীষ্মের রোদ থেকে রক্ষা পেতে গাছের ছায়ার নিচে বসার জন্য সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকাল সন্ধ্যা মাঠের চারপাশে ৫০টি সাউন্ড বক্স থেকে ভেসে আসে সুরের মূর্চ্ছনা।”
তবে পুরপ্রধানের আক্ষেপ, “পুরসভার সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যেও এত সব করা হয়েছে হেরিটেজ মাঠের সংরক্ষণ ও সৌর্ন্দয্যের প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে। এত কিছুর পরও জেলা প্রশাসনের অসহযোগিতায় মাঠ ধ্বংস হতে বসেছে।” নীলরতনবাবু বলেন, “মাঠ বাঁচাতে হলে হেলিপ্যাড ও অন্যান্য মেলার মতো আয়োজন বন্ধ করতে হবে। তবেই বহরমপুরের ফুসফুস ব্যারাক স্কোয়ার মাঠে প্রাণ ফিরবে। জেলাশাসক ও ভূমি সংস্কার দফতরের জেলা আধিকারিকের কাছে বহুবার সেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রতিবারই বলা হয়েছে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বৈঠকও হয়নি, সিদ্ধান্তও হয়নি।”
ভুমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের জেলা আধিকারিক তথা অতিরিক্ত জেলাশাসক অরবিন্দ মিনার সাফ কথা, “পুরপ্রধান ঠিক কথা বলছেন না। ওই মাঠের মালিক সরকার। ফলে সেখানে তো সরকারি অনুষ্ঠান হবেই।” প্রশাসনের এ হেন মতিগতির বদল না ঘটলে ঐতিহাসিক ব্যারাক স্কোয়ারের ভবিতব্য সহজেই অনুমেয়।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ,
জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১