কৃষ্ণনগরে তাপস। নিজস্ব চিত্র।
তাপস পাল জিতলেন। কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্র আবারও দখল করল তৃণমূল। কিন্তু শহর কৃষ্ণনগর কেমন যেন বদলে গেল! উদাসীন শহরের বুকে গুটিকয় মাত্র সমর্থক নিয়ে বিজয় মিছিল করলেন তাপস পাল। পেলেন না জয়ের শংসাপত্রও। সৌজন্যে ইভিএম বিভ্রাট।
সাধারণত ভোট গণনার দিন গণনাকেন্দ্রের দু’দিকে বিজয়ী দলের সমর্থকদের ভিড় উপচে পড়ে। সে দৃশ্য এবার যেন একেবারেই উধাও কৃষ্ণনগরে। ফাঁকা রাস্তায় গুটিকয়েক সমর্থক ছিলেন, তাঁদের অনুরোধেই তাপস পাল নাচলেনও। কিন্তু সেই নাচ দেখতেও কেউ তেমন বেরিয়ে এলেন না ঘর ছেড়ে। কিন্তু কেন এমন হল? ভোটের ফল বলছে সামগ্রিক ভাবে কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রে জিতলেও তাপসবাবু এই শহরে বিজেপি-র সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে ১৫ হাজারের মতো ভোটে পিছিয়ে ছিল। অর্থাৎ, মাত্র কয়েক মাস আগেই যে শহর দখল করেছিল তৃণমূল, সেই শহরই এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাপসবাবুর পাশে হাঁটছিলেন কৃষ্ণনগর পুরসভার এক কাউন্সিলর। অকপটে তিনি বলে ফেললেন, “কৃষ্ণনগর শহরের মানুষ তো আর তাপসবাবুর সঙ্গে নেই। তাই এই বিজয় মিছিলে তেমন পা মেলাতে দেখা যাচ্ছে না শহরের মানুষকে।”
কৃষ্ণনগর কংগ্রেসের শহর বলেই পরিচিত ছিল। কিন্তু মাস ছ’য়েক আগে পুরসভা নির্বাচনের আগে পুরপ্রধানের নেতৃত্বে কংগ্রেসের কাউন্সিলররা তৃণমূলে যোগ দেন। সেই পুরনির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল প্রায় ৫১ হাজার ৮শো ভোট। আর বিজেপি ভোট পেয়েছিল ৪ হাজার ৩শো-র কাছাকাছি। কিন্তু এ বার লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ভোট কমে হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। অন্য দিকে বিজেপি এর ভোট বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ৫ শো। এই শহরে তৃণমূলের থেকে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজারের মত বেশি ভোটে এগিয়ে বিজেপি প্রার্থী জলুবাবু। তৃণমূলের নেতাদের কাছে যা ‘অকল্পনীয়’। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে শহরের মানুষ তাদের পাশ থেকে সরে যাওয়ার পিছনে ‘জলুবাবু ম্যজিক’ ছাড়া আর কোনও কারণ দেখতে পাচ্ছেন না।
দুপুর একটা নাগাদ কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের ভোটের ফল ঘোষণা হয়। তারপরই গণনা কেন্দ্র বিপ্রদাস পাল চৌধুরী ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি কলেজে হাজির হন তাপসবাবু। সঙ্গী জেলা সভাপতি, মন্ত্রী ও বিধায়করা। সদ্য নির্বাচিত তৃণমূল প্রার্থীর পরণে সুতোর কাজ করা সাদা চুড়িদার-পাঞ্জাবী সবুজে আবিরে তখন সবটাই সবুজ। মাথায় বাঁধা ছিল সবুজ কাপড়। তাপস পাল আসতেই তাঁকে ঘিরে ধরেন গণনাকেন্দ্রের ভিতরে থাকা তৃণমূল সমর্থকরা। প্রতিক্রিয়া জানতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় সংবাদমাধ্যমে। ব্যস, ওই টুকুই। ভিড় ঠেলে তাপসবাবু ঢুকে যান মূল গণনাকেন্দ্রের ভিতরে। গণনাকেন্দ্রের বাইরে পিচের রাস্তা তখন ফাঁকা হতে শুরু করেছে।
জলুবাবুর হেরে যাওয়ায় মনমরা শহরের মানুষ। কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা বলেন, “ভোটগণনা কেন্দ্রের পাশে সাধারণত শহরের মানুষ ভিড় করেন। বিজয়ী প্রার্থীকে ঘিরে তাঁরাই প্রাথমিক উচ্ছ্বাসটা দেখান। যেহেতু তাঁরা আমাদের ভোট দেননি তাই তাঁরা আসেননি।” একই কথা শুনিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষ্ণনাগরিক। তিনি বলেন, ‘‘তাপসবাবু জিতলেও এটা পরিষ্কার যে, এই শহরের মানুষ তাঁকে চাননি। তাই শুধু গণনাকেন্দ্রের কাছে কেন,শহরের কোথাও তেমন উচ্ছ্বাস দেখাননি শহরের মানুষ।” কিন্তু এসব কথায় কান দিতে রাজি নন তাপসবাবু। জয়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি এই জয় আমার নেত্রীর পায়ে উৎসর্গ করলাম।” দ্বিতীয়বার জিতে তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে সঙ্গে দলের বিধায়ক ও নেতা কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যই এই জয় সম্ভব হয়েছে।” আর পাশে দাঁড়িয়ে এক গাল হেসে তাপসজায়া নন্দিনী পাল বলেন, “আমি এই ফল সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম। কারণ আমি জানতাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ও যে ভাবে গত পাঁচ বছর ধরে মানুষের জন্য কাজ করেছে তার ফল পাবেই।”
বিভিন্ন বিধানসভা কেন্দ্রে কয়েক রাউন্ড গণনার ফল বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিষ্কার হতে থাকে এই কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ। প্রতি রাউন্ডেই অন্যদের থেকে এগিয়ে যেতে থাকেন তাপসবাবু। গণনা যত এগোতে থাকে ততই যেন অন্য দলের কাউন্টিং এজেন্টদের সংখ্যা কমতে থাকে। সকালের দিকে বিজেপি প্রার্থী সত্যব্রতবাবু গণনাকেন্দ্রে এসে ঘুরে যান। নির্বিকার চিত্তে বসে থাকতে দেখা যায় সিপিএম প্রার্থী শান্তনু ঝা-কে। দলের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত একের পর এক এলাকা থেকে পিছিয়ে পড়ার খবর আসতে থাকে। কিন্তু কেন এমন ফল হল সিপিএমের? কিছুটা হতাশ হয়েই শান্তনুবাবু বলেন, “কেন এমন ফল হল, তা বুঝতে পারছি না। এই মুহূর্তে এর ব্যাখ্যা করা মুশকিল’’ এরই মধ্যে একটি বুথের ইভিএম খারাপ থাকার কারণে জয়ের শংসাপত্র বৃহস্পতিবার হাতে পেলেন না তাপস পাল। জেলা শাসক পি বি সালিম বলেন, “ নির্বাচন কমিশনের অনুমতি পেলে আমরা শনিবারই তাপসবাবুকে শংসাপত্র দিয়ে দেব।”