নজর সিসিটিভিতে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
ঘটনা ১: হাইবেঞ্চের উপর গুছিয়ে বসে সিগারেট ধরিয়েছিলেন দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্র। আচমকা পিঠের উপর মৃদু টোকা। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ! দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং কলেজের অধ্যক্ষ। লজ্জায় সিগারেট ফেলে একছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলেন ওই ছাত্র।
ঘটনা ২: দিনকয়েক আগে কলেজের নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গে বচসা জুড়েছিলেন এক বহিরাগত। ব্যাপারটা নজরে আসতে ঘটনাস্থলে হাজির অধ্যক্ষ। তারপরে আর কথা বাড়াননি ওই বহিরাগত। অধ্যক্ষের সামনে দুঃখপ্রকাশ করে তিনি কলেজ ছেড়ে চলে যান।
নদিয়ার চাপড়া বাঙালঝি কলেজে নিত্যদিনের এমন সব ঘটনা অবশ্য গা সওয়া হয়ে গিয়েছে পড়ুয়া-শিক্ষক সকলেরই। কারণ শৃঙ্খলা আনতে মাস কয়েক আগে ওই কলেজে বসানো হয় সিসিটিভি। সম্প্রতি সেই সংখ্যাটা আরও বাড়ানো হয়েছে। কলেজ চলাকালীন সেই সিসিটিভিতে নজর রাখছেন অধ্যক্ষ নিজে। শুধু তাই নয়, কলেজের মূল ফটকে ঝুলছে একটি বিজ্ঞপ্তি। তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কলেজ শুরুর পর থেকে বিকেল ৩ টে পযর্ন্ত কেউ কলেজের বাইরে যেতে পারবেন না। ওই সময় গেট তালাবন্ধ থাকবে। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার থাকলে অধ্যক্ষের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিতে হবে।
প্রথম দিকে এমন নিয়মে মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ। ছাত্রদেরও কেউ কেউ ‘খিদে পেয়েছে’ বলে কলেজের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অধ্যক্ষের অনড় মনোভাবে সে সব চেষ্টা জলে গিয়েছে।
কিন্তু কেন এমন নিয়ম? অধ্যক্ষ কৃষ্ণগোপাল রায় জানান, ইউজিসি-র নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষককে দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে কলেজে থাকতে হবে। কলেজ শুরু হয় সকাল ১০টায়। সেই হিসাবে বিকেল ৩টে পর্যন্ত কলেজে থাকার কথা শিক্ষকদের। তিনি বলেন, “বহু পড়ুয়া শেষের দিকে ক্লাস না করে দুপুরে বাড়ি চলে যেতেন। কোনও কোনও শিক্ষক-শিক্ষিকারাও মাঝেমধ্যে এমনটা করতেন। সেটা রুখতেই এই ব্যবস্থা।”
তবে অধ্যক্ষের এই কড়া অবস্থানে আপত্তি না থাকলেও সীমান্ত এলাকা থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে কলেজের টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদ এক ঘণ্টা সময় এগিয়ে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছে। ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব শেখ বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থেই অধ্যক্ষ এমন পদক্ষেপ করেছেন। আমরাও তাঁর সঙ্গে আছি। তবে সময়টা এক ঘণ্টা এগিয়ে এনে ১২টা থেকে ২টো করার জন্য অনুরোধ করেছি। কারণ আমাদের কলেজের বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী সীমান্ত এলাকা থেকে আসে। তাদের কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়াটা জরুরি।”
অধ্যক্ষও ছাত্র সংসদের এমন অনুরোধ ভেবে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কলেজের টিচার্স কাউন্সিলের সদস্য বাসুদেব ঘোষ বলেন, “আমাদের কোনও আপত্তি নেই। অন্য কলেজেও যদি এমনটা হয় তাহলে কিন্তু অনেক সমস্যারই সমাধান হবে।”
২০০১ সালে চালু হওয়া ওই কলেজে বর্তমান ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। এই বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে সামাল দিতে কলেজ গেট না হয় বন্ধ করা হল। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে সিসিটিভি কেন? অধ্যক্ষের ব্যাখ্যা, মূলত যে সব শ্রেণিকক্ষ একটু দূরে সেই সব ঘরেই ক্যামেরা বসানো হয়েছে। তার ফলে ক্লাসরুমে ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমতো পড়াশোনা করছে নাকি গল্প করছে সেদিকে নজর রাখা যায়। পরে তাদের ডেকে সাবধান করতে পারি।” তিনি আরও বলেন, “আবার কোনও ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি কমে গেলে সেই ক্লাসের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অনুপস্থিত পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানার চেষ্টা করি। সেই মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও করা হয়। সিসিটিভির কারণে পড়ুয়ারা এখন নকলের পথও মাড়ায় না।”
কলেজ ভোটে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় টিএমসিপির ছাত্রছাত্রীরা দাবি করেছিল এসএফআইয়ের সমর্থকরা কলেজে বেশি ঢুকেছিল। এবং অনেক আগে থেকেই তারা ঢুকেছিল। তা নিয়ে কলেজ চত্বরে উত্তেজনাও ছড়ায়। কিন্তু সিসিটিভির ফুটেজ দেখিয়ে অধ্যক্ষ প্রমাণ করে দেন যে তাদের দাবি ঠিক নয়।
অগস্ট মাসের শেষের দিকে পরীক্ষায় নকল করতে বাধা দেওয়ায় ছাত্র সংসদের হাতে অপমানিত হয়ে কৃষ্ণগোপালবাবু পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। পরে তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের বাড়িতে বসে তিনি তার পদত্যাদপত্র প্রত্যাহারও করে নেন। সেই সময় শাসক দলের পক্ষ থেকে অধ্যক্ষকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, চাপড়া বাঙালঝি কলেজে কোনও টুকলি হবে না। আর কলেজের পঠনপাঠনের বিষয়ে অধ্যক্ষই শেষ কথা বলবেন।
এখনও পর্যন্ত অবশ্য তেমনটাই চলছে। তবে কলেজের শিক্ষক ও পড়ুয়াদের একাংশ অবশ্য জানাচ্ছেন, শাসক দলের আশ্বাসের থেকেও কৃতিত্বটা কিন্তু সিসিটিভিরই বেশি।