কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসে খুন হয়েছিলেন কোরপান শাহ নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবক। ‘খুনি’ হিসাবে যাঁদের দিকে আঙুল উঠেছে তাঁরা সকলেই ভবিষ্যতের চিকিত্সক। ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন চার ছাত্র। তারমধ্যে রয়েছেন মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জের ইউসুফ জামিল।
শিক্ষিত পরিবারের ছেলে ইউসুফ ছোট থেকেই মেধাবী, শান্ত। বাবা গ্রামের হাইস্কুলের শিক্ষক। সেই স্কুলেই সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। পরে আল আমিন মিশনের খালিতপুর শাখায় ভর্তি হন। সেখান থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক, জয়েন্টে ১৪৮ র্যাঙ্ক। তারপর চিকিত্সক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া। এবারই তাঁর ফাইন্যাল পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।
সেই ছেলে যে এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে সে কথা মানতে নারাজ পরিবার। শুধু পরিবার নয়, আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। এলাকায় পরোপকারী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন জামিল। “মেডিক্যাল কলেজে পড়তে যাওয়ার পর থেকে যে ভাবে পেরেছে আমাদের সাহায্য করেছে ছেলেটা’’বলছেন পাড়া প্রতিবেশীরা। কেউ মানতে চান না, যে ছেলে কলকাতা থেকে গ্রামে এসে মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে, সে কী ভাবে একটা লোকের প্রাণ নিয়ে নিল!
ঝাড়খন্ড লাগোয়া মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জের চাঁদপুর, অন্তর্দীপা, ভাসাইপাইকর, ইসলামপুর, সাহেবনগর-সহ ১২টি গ্রামে জামিল ছিল একমাত্র ডাক্তারি পড়ুয়া। একদিন পড়া শেষ করে চিকিত্সক হয়ে নিজের গ্রাম সাহেবনগরে ফিরবে বলেই আশা করেছিলেন বাসিন্দারা। হতাশ করেননি ইউসুফও। সে কথা এক নাগাড়ে বলে চলেন বাসুদেবপুরের সেলিম শেখ, নাসির আহমেদ, তারাপুরের দানেশুর রহমান বা রফিকুল ইসলামরা। এঁরা প্রত্যেকে কোনও না কোনও সময় সাহায্য পেয়েছেন ইউসুফের কাছে।
অ্যানিমিয়া আক্রান্ত চার বছরের ছেলে নাদিম ইরফানকে সেদিন কোলে তুলে নিয়ে জামিল ছুটে গিয়েছিলেন এনআরএস হাসপাতালে। দু’বছর ধরে ছেলের চিকিত্সার সব ব্যবস্থাই জামিলের হাত ধরে। তাই ছেলের জীবন রক্ষাকর্তা কারও প্রাণ নিতে পারে তা বিশ্বাস করতে পারছেন না নাসির আহম্মেদ। কোরপানের ঘটনার পরেও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন দানেশুর রহমান। ভরসা দিয়ে কলকাতায় ডেকে নিয়ে জামিল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে বাড়ি ফিরেছেন জানাতে গিয়ে গলা কেঁপে যায় দানেশুরের।
গ্রামের কোয়াক চিকিত্সক বৃদ্ধ তাজামুল হক বলেন, “ঝাড়খন্ড সীমান্তের ১২ টি গ্রামে এ পর্যন্ত একজনও এমবিবিএস চিকিত্সক নেই। তাই জামিল ছিল আমাদের একমাত্র আশা ভরসা। যখনই বাড়ি আসত তখনই তার বাড়িতে বসে যেত রোগীদের মেলা। ও বলত ‘আমি তো এখনও ডাক্তার হইনি। কলকাতায় আমার কাছে যেও বড় ডাক্তারকে দেখিয়ে দেব। কথা শুনেই ভরসা পেতাম।”
জামিলের বাবা আব্দুর রহমান গ্রামেরই হাইস্কুলের শিক্ষক, কাকা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার, দুই দাদা ফারুক হোসেন ও আনোয়ার হাবিরও স্কুল শিক্ষক। বৌদি জিনিয়া কাস্তুরি বিশ্বাসও শিক্ষিকা। সকলেই নির্বাক জামিলের গ্রেফতারির খবরে।
১৬ নভেম্বর কোরপান খুনের ঘটনার পরেও দু’বার গ্রামে এসেছে জামিল। কাকা হাজি মাসুদ আলম বলেন, “জামিল বলেছিল কোনও ভয় নেই। ঘটনার সঙ্গে কোনও যোগ নেই আমার। ৬ জানুয়ারি থেকে ফাইন্যাল পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল। তাই ৩ জানুয়ারি কলকাতায় হোস্টেলে ফিরে যায় সে। কিন্তু পরীক্ষাটা দেওয়া হল না।”
জামিলের বাবা এই মুহূর্তে কলকাতায়। তিনিও ছেলেকে বলেছিলেন, অন্যায় যদি না করে থাকো কোনও কিছুতেই ভয় করবে না। তবু সোমবার বিকেলে ছেলে গ্রেফতার হওয়ার খবর পেয়ে পরিবারের সকলেই ভেঙে পড়েছেন। মা হাসনাতুন্নেসা বিবি সেই ছেড়েছেন খাওয়া দাওয়া। কিন্তু ছেলের উপর অগাধ আস্থা রেখে মা বলছেন, “মানুষের প্রাণ বাঁচাবার কসম করে বাড়ি ছেড়েছে জামিল, সে কখনও কাউকে প্রাণে মারতেই পারে না। নির্দোষ প্রমাণ হয়ে গ্রামে চিকিত্সক হয়েই একদিন ফিরে আসবে আমার ছেলে।”
ভরসা রাখছেন পাশের গ্রামের স্কুল শিক্ষক আব্দুর রউফও। তিনি বলেন, “শুধু কৃতী ছাত্রই নয়, অত নম্র ভদ্র ছেলে খুব কম দেখেছি। বিশ্বাস করতে পারি না সেই ছেলে এমন কাণ্ড করতে পারে।”