খেলনা রথ আর বেলুনে ছেয়েছে বহরমপুরের রাস্তা

‘জ্যৈষ্ঠ মাসে ষষ্ঠীপুজো, জামাই আনতে দড়ো (দৌড়াও), আষাঢ় মাসে রথযাত্রা, লোক বয়েছে জড়ো’ রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে বহরমপুর-সহ মুশির্দাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে মেলায় উপচে পড়ল ভিড়। বহরমপুরে ভাগীরথীর পাড় লাগোয়া জগন্নাথ ঘাটে ও কৃষ্ণনাথ কলেজ ঘাটে রথের মেলায় মানুষের মাথার মিছিলে হারিয়ে গেল কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গোরাবাজার শ্মশানঘাটের রাস্তা, পুরনো কান্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে নতুন বাজার যাওয়ার রাস্তা। জিলিপি, পাঁপড় ভাজা থেকে রান্নার টুকিটাকি সামগ্রীবিকিকিনির হাটে কী নেই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বহরমপুর শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৪ ০০:৪৭
Share:

রথের রশি হাতে। —নিজস্ব চিত্র।

‘জ্যৈষ্ঠ মাসে ষষ্ঠীপুজো, জামাই আনতে দড়ো (দৌড়াও), আষাঢ় মাসে রথযাত্রা, লোক বয়েছে জড়ো’ রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে বহরমপুর-সহ মুশির্দাবাদ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে মেলায় উপচে পড়ল ভিড়। বহরমপুরে ভাগীরথীর পাড় লাগোয়া জগন্নাথ ঘাটে ও কৃষ্ণনাথ কলেজ ঘাটে রথের মেলায় মানুষের মাথার মিছিলে হারিয়ে গেল কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গোরাবাজার শ্মশানঘাটের রাস্তা, পুরনো কান্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে নতুন বাজার যাওয়ার রাস্তা। জিলিপি, পাঁপড় ভাজা থেকে রান্নার টুকিটাকি সামগ্রীবিকিকিনির হাটে কী নেই। কচিকাঁচাদের হাতে ধরা খেলনা রথ ও বিভিন্ন রঙের বেলুনের সারি।

Advertisement

বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের সংস্কৃতের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান কেদারেশ্বর চক্রবর্তী জানান, রথযাত্রার প্রথম শুরু হয়েছিল কবে, সঠিক ভাবে বলা না গেলেও এটা বলা যায় যে, ওড়িশার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন’র শাসনকালে একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করে বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। ওই বিগ্রহ স্থাপনের পর থেকেই পুরীতে শুরু হয় রথযাত্রা। পরে পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের সর্বত্র রথযাত্রা পালিত হয় পুরীর রথযাত্রাকে অনুকরণ করেই। ইতিহাস গবেষকদের মতে, সুবে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ জেলায় সুপ্রাচীন কাল থেকেই রথযাত্রাকে ঘিরে চরম উন্মাদনা ছিল। বিভিন্ন রাজা-মাহারাজ-জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই রথযাত্রা শুরু হলেও পরে আর্থিক কারণে শুরুর আড়ম্বর ও জাঁকজমক গতানুগতিকতায় পরিণত হয়। বহরমপুরের প্রবীণ নাগরিক সাবিত্রীপ্রসাদ গুপ্ত বলেন, “বহরমপুরে এক সময়ে মহাসমারোহে রথযাত্রা পালিত হত। বহরমপুর-সহ জেলার বিভিন্ন রাজা-মহারাজ ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই রথযাত্রা শুরু হলেও আর্থিক কারণে শুরুর আড়ম্বর ও জাঁকজমক পরে নিয়ম রক্ষার্থে পরিণত হয়েছে।”

কাশিমবাজার বড় ও ছোট রাজবাড়ির রথকে ঘিরে যেমন এক সময়ে ব্যাপক উন্মাদনা ছিল। প্রায় আড়াইশো বছর আগে বহরমপুর সৈয়দাবাদের মহারাজা নন্দকুমারের ছোট রাজবাড়ির রথযাত্রা শুরু হয়েছিল। কাঠের তৈরি ওই রথটি ছিল চওড়ায় ৮ ফুট ও লম্বায় ২০ ফুট। ওই বিশালতার কারণে রথের পথ-পরিক্রমা করা সম্ভব হত না। পুরুষানুক্রমে চলে আসা কাঠের তৈরি ওই রথের সংস্কার না হওয়ায় রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে তা নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৬৫ সালে শেষ রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এখন রথের দিন অন্যান্য ক্রিয়া-কর্ম পালিত হয়। একই ভাবে কাশিমবাজার বড় রাজবাড়িতেও নিয়ম রক্ষার্থে রথের দিন আচার পালন হয়ে থাকে।

Advertisement

বহরমপুর নতুন বাজারের কাছে দামোদর আখড়ার রথযাত্রা প্রায় ১৭৫ বছরেরও বেশি পুরনো। রথের দিন রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহকে গঙ্গাস্নান করিয়ে ৬ ফুট চওড়া ও ১৫ ফুট লম্বা রথের উপরে স্থাপনের পরে রথ সাজিয়ে শহর পরিক্রমা করানো হয়। তবে বহরমপুরের উল্লেখযোগ্য ছিল সৈদাবাদের কেদার মাহাতাব পরিবারের পারিবারিক রথযাত্রা। প্রায় ১১০ বছরের বেশি প্রাচীন ওই রথের চাকাগুলি তামা দিয়ে তৈরি, ঘোড়া ও রথের সারথীও ছিল পেতলের। ওই রথে রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি স্থাপিত হত। ১৯৭৭ সালে পথ-পরিক্রমার সময়ে রথের চাকায় এক যুবকের হাত ও পায়ের আঙুল পিষে যাওয়ার পর থেকেই ওই রথযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়।

বহরমপুর সদর হাসপাতাল লাগোয়া জগন্নাথদেব মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডের উদ্যোগে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রায় আড়াইশো বছরের বেশি প্রাচীন ওই রথযাত্রা উৎসব-আড়ম্বরের সঙ্গেই পালন করা হয়। সম্পূর্ণ পেতলের তৈরি ওই রথটি চওড়ায় ৮ ফুট ও লম্বায় ২০ ফুট। ট্রাস্টি বোর্ডের নিজস্ব জমি, বাড়ি বাড়ি ও মন্দিরের প্রণামী থেকেই রথযাত্রার সমস্ত খরচ বহণ করা হয়। রথের দিন পুরীর রথযাত্রার অনুকরণে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহকে পৃথকভাবে ১০৮ ঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে রথের উপরে স্থাপন করা হয়এ বছরও ব্যতিক্রম ঘটেনি।

পুরীর রথযাত্রার অনুকরণে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের দক্ষিণ দিক লাগোয়া ভাগীরথী পাড়ের জগন্নাথদেবের মন্দিরে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মন্দিরের পূজারী ওড়িশাবাসী ব্রাহ্মণ সেবাইতদের দ্বারা প্রায় দুশো বছর আগে ওই রথযাত্রার সূচনা হয়। বর্তমানে তাঁদের বংশধর সেবাইতরা ওই প্রাচীন রথযাত্রা পরিচালনা করেন। রথযাত্রা উপলক্ষে এদিন সকাল থেকে মন্দির প্রাঙ্গণে মহাভোজের আয়োজন করা হয়। বহরমপুর লাগোয়া হরিদাসমাটি এলাকায় মন্দির কর্তৃপক্ষের নিজস্ব জমিতে প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন ওই রথের মাসির বাড়ি যাওয়া উপলক্ষে অজস্র ভক্তগণ ওই মন্দির প্রাঙ্গণে জড়ো হন। হরিদাসমাটি এলাকায় ওই রথকে ঘিরে এখন সাত দিন ধরে চলবে পূজার্চনা। উল্টো রথের দিন ওই রথ ফের জগন্নাথদেবের মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হবে।

সব মিলিয়ে লোকসমাগমে মহা-উৎসবের মেজাজে মুর্শিদাবাদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন