ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে ঘিরে ছাত্রেরা। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
স্বস্তির শ্বাস নিতে না নিতেই ফের জেগে উঠল অস্বস্তির কাঁটা!
শুক্রবার এসএফআই, সিপি ও টিএমসিপি’র চাপে জঙ্গিপুর কলেজ কর্তৃপক্ষ অনলাইনে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঘটনার ঠিক তিন দিনের মাথায় এসএফআই ও টিএমসিপি দাবি করল, আবেদনকারী সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীকে ভর্তি নিতে হবে। সোমবার দফায় দফায় ওই দুই ছাত্র সংগঠনের ঘেরাও ও বিক্ষোভে ‘ক্লান্ত’ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অসীম মণ্ডল নিজের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি চাইলেন। অসীমবাবু বলেন, “ছাত্র সংগঠনগুলির দাবি মেনেই তো অনলাইনে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। সেখানে ভর্তি হওয়ার কথা মেধা অনুযায়ী। এখন আচমকা এরকম দাবি করলে তো খুবই সমস্যার কথা।” তিনি বলেন, “গত বছর ছাত্র সংগঠনগুলির দাবি মেনে নির্দিষ্ট আসনের থেকে অনেক বেশি ছাত্র ভর্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ৮৪ হাজার টাকা জরিমানা গুণতে হয়েছিল। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবার আর আমরা চাইছি না।”
সম্প্রতি জঙ্গিপুর কলেজে অনলাইনে ভর্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল কলেজের ছাত্র সংগঠনগুলি। শুক্রবার কলেজের পরিচালন সমিতির সভায় সেই দাবি মেনে নেওয়া হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলেন, আর যাই হোক, কলেজে নির্দিষ্ট আসনের থেকে অতিরিক্ত ছাত্র ভর্তি নিয়ে আর কেউ জোর করতে পারবে না। কিন্তু সে ভাবনা ভুল প্রমাণ করে এদিন বিক্ষোভকারী তৃণমূল ও এসএফআই সাফ জানিয়ে দিয়েছে, অনার্সের বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত আসন যা-ই থাক না কেন, গত বছর পর্যন্ত কলেজে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্সে যত জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছে এবারেও সেই সংখ্যক ছাত্রকেই ভর্তি নিতে হবে। তা না হলে কলেজে ছাত্র ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এ বছর জানুয়ারি মাস থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন অসীমবাবু। কিন্তু গতবারের পরিস্থিতি তিনিও বিলক্ষণ জানেন। অসীমবাবু বলেন, “এভাবে যখন তখন ছাত্র বিক্ষোভ সামাল দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অকারণে এদিন আমাকে দু’ঘণ্টা ধরে ছাত্ররা ঘেরাও করে রাখল। কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতিকে আমি বিষয়টি জানিয়ে অব্যাহতি চেয়েছি।”
অসীমবাবু জানান, গত বছর বাড়তি ছাত্র ভর্তির খেসারত হিসেবে কলেজ ফান্ড থেকে ৮৪ হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জরিমানা মেটাতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, এর জন্য পদে পদে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভর্ৎসনা শুনতে হচ্ছে কলেজ কর্তৃপক্ষকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, এ বছর থেকে অনার্সে অনুমোদনের বাইরে একজন ছাত্রকেও ভর্তি করলে তার রেজিষ্ট্রেশন দেওয়া হবে না। এর পরেও এই অন্যায় আবদার মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, দীর্ঘদিন থেকে জঙ্গিপুর কলেজে অনার্সে যা আসন তার দ্বিগুণেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়ে এসেছে। গত বছর বাংলা অনার্সে ৭৩টি আসন থাকলেও ভর্তি করা হয়েছিল ২০০ জনকে। ইংরেজি অনার্সে ৪৯ জনের জায়গায় ভর্তি নেওয়া হয়েছিল ১১০ জনকে। এমনকি ল্যাবরেটরি ব্যবহার হয় এমন বিষয়, ভূগোল অনার্সেও ৮৪ জনের জায়গায় ২১০ জন পড়ুয়া ভর্তি হয়েছিলেন। এত ছাত্র ল্যাবরেটরিতে কীভাবে কাজ করল সে প্রশ্নও তপলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কলেজের মোট ১৩টি বিষয়ে অনার্সে এভাবেই নির্দিষ্ট আসনের থেকে অনেক বেশি ছাত্রছাত্রী ভর্তি নেওয়া হয়েছিল। পাশ কোর্সে ৭১৬ জনের জায়গায় দেড় হাজারেরও বেশি ভর্তি নেওয়া হয়েছে। অসীমবাবু বলেন, “সকলেই চান যাতে স্থানীয় সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হতে পারে। তাই বলে মেধাকে বাদ দিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে তো আর ভর্তি নেওয়া সম্ভব নয়।”
কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি ভজন সরকার বলেন, ‘‘গত বছর ৮৪ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে কোনওরকমে পার পেয়েছি। তাই এবার আর বাড়তি ছাত্র ভর্তি নেওয়া সম্ভব নয়। কলেজে এদিন যা হয়েছে তা সবই জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। তিনিও আর দায়িত্বে থাকতে চাইছেন না। বৃহস্পতিবার ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের নিয়ে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব। সেখানে অনুমোদন পেলে ভাল। না পেলে কোনওভাবেই বাড়তি ছাত্র ভর্তি করা যাবে না।” কলেজ পরিচালন সমিতির সদস্য ও জঙ্গিপুরের পুর কাউন্সিলার কংগ্রেসের বিকাশ নন্দ বলেন, ‘‘নিয়মের বাইরে ছাত্র ভর্তির অন্যায় আবদার মানতে গেলে কলেজকেই বিপদে পড়তে হবে। অনলাইনে ভর্তি চালু করে ভেবেছিলাম অশান্তি বোধহয় কমল। কিন্তু সোমবারে যা হল তাতে মনে হল অশান্তি বাড়ল বই কমল না।” তিনি বলেন, “যাঁরা অনার্সে যত খুশি ছাত্র ভর্তির দাবি করছেন তাঁরা সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আসন বাড়ানোর দাবি করুন। তা না করে কলেজে অধ্যক্ষকে ঘেরাও করে কী হবে?”
তৃণমূলের রাজ্য কমিটির সদস্য শেখ ফুরকান অবশ্য এদিন বলছেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ঠিক রেখে কীভাবে বেশি সংখ্যক ছাত্রকে কলেজে ভর্তি করা যায় সেটা অবশ্যই দেখা উচিত। নাহলে স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীরা যাবে কোথায়? দরকার হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দরবার করে বাড়তি আসন অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।” এসএফআইয়ের জঙ্গিপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘ প্রায় ৩০টি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল রয়েছে এই এলাকায়। ফলে এলাকার সমস্ত ছাত্রছাত্রীরাই এই কলেজের উপরেই নির্ভরশীল। আমরা মুখে উচ্চশিক্ষা প্রসারের কথা বলব অথচ তাদের কলেজে ভর্তিতে বাধ সাধব তা তো হতে পারে না। সেই কারণেই সকলকে ভর্তির দাবি তুলে আন্দোলন করছি।” তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কলেজ কমিটির আহ্বায়ক খাইরুল আলম খান বলেন, ‘‘দেশের আইন বলছে সকলকে শিক্ষার অধিকার দিতে হবে। কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেও আমরা সেই দাবিটাই তো তুলছি। সমস্যা সমাধানের দায়িত্বও নিতে হবে কলেজ কর্তৃপক্ষকেই।”
আর কলেজের ছাত্র সংসদের সম্পাদক এসএফআইয়ের ইঞ্জামুল হকের সাফ কথা, ‘‘গত বছর পর্যন্ত যেভাবে ভর্তি হয়েছে সেটা তাহলে কীভাবে আইনসিদ্ধ হল? সেটা যদি আইন মতে হয়ে থাকে তবে এবারও সেভাবেই ভর্তি করতে হবে।” এদিন অবশ্য টিএমসি কিংবা এসএফআইয়ের মতো ঘেরাও কিংবা বিক্ষোভে সামিল হয়নি ছাত্র পরিষদ। তবে জঙ্গিপুর শহর ছাত্র পরিষদের সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “হঠাৎ করে আগের নিয়ম বদলে দিলে তো অসুবিধায় পড়বেন সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত কলেজের পরিকাঠামো বাড়িয়ে আরও বেশি সংখ্যক ছাত্রকে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া।” না হলে ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে তাঁরাও যে অন্য সংগঠনগুলোর মতোই আন্দোলনে নামবেন সে কথাও জানিয়ে দিয়েছেন ওই ছাত্র নেতা।