জয়ের শংসাপত্র হাতে সস্ত্রীক অভিজিৎ। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
তৃণমূলের ‘দাপট’ ও বিজেপির ‘ঝড়’ রুখে দিয়ে জঙ্গিপুরে নিজের জয় ধরে রাখলেন জঙ্গিপুরের কংগ্রেস প্রার্থী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। শুধু তাই নয়, ২০১২ সালের উপ-নির্বাচনে ২৫৩৬ ভোটের ব্যবধানকে বাড়িয়ে নিলেন ৮ হাজারে। বাবা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে জেতা জঙ্গিপুর আসনে এবারে অভিজিতের জয় নিয়ে প্রথমদিকে কিছুটা সংশয় ছিল দলের অন্দরেই। ভোটের আগে দিন চারেকের জন্য জঙ্গিপুরে এসে দাদার জন্য প্রচারে নামেন বোন শর্মিষ্ঠাও।
এদিন ফল ঘোষণার পরে কেটে যায় যাবতীয় সংশয়, আশঙ্কার মেঘ। অভিজিৎ বলছেন, “সাংগঠনিক শক্তির জোরেই সব ঝড় সামলে জঙ্গিপুরে এই জয় এসেছে। কেন্দ্রে এতদিন কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। সাংসদ হিসেবে কাজ করতে সুবিধে হয়েছে। এখন বিজেপির সরকার হতে চলেছে কেন্দ্রে। আমার বিশ্বাস, উন্নয়নের প্রশ্নে সাংসদ হিসেবে এই সরকারের কাছ থেকেও আমি পূর্ণ সহযোগিতা পাব।” তাঁর কথায়, “এ রাজ্যে বামপন্থীরা মাত্র ২টি আসন পেলেও তাদের রাজনৈতিক শক্তি খুব একটা কমেনি। বিজেপি এ রাজ্যে ২টি আসন পেয়েছে তাই নয়, রাজ্যে তাদের শক্তি অনেকটাই বেড়েছে। আশা করছি রাজ্যের উন্নয়নে মিলে মিশে কাজের পরিবেশ তৈরিতে সকলেই সাহায্য করবেন।”
এদিন রঘুনাথগঞ্জ হাই স্কুলে গণনা চলাকালীন সেখানে যাননি অভিজিৎ। নিজের দেউলির বাড়িতে বসেই দুপুর পর্যন্ত খোঁজখবর করেছেন। গণনাকেন্দ্রে আসেননি তৃণমূল প্রার্থী শেখ নুরুল ইসলামও। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে গত রাতেই জঙ্গিপুর থেকে বারাসাতে ফিরে গিয়েছেন তিনি। বিজেপির সম্রাট ঘোষ সকালে কিছুক্ষণের জন্য গণনাকেন্দ্রে এলেও ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বাড়ি ফিরে যান তিনিও। ব্যতিক্রমী সিপিএমের মুজাফ্ফর হোসেন। সাত-সকালেই তিনি গণনাকেন্দ্রে চলে এসেছিলেন। ছিলেন দুপুর পর্যন্ত। তারপর একের পর এক নিজের পিছিয়ে পড়ার খবর আসতে থাকলে তিনি গণনাকেন্দ্র ছেড়ে চলে যান। বেলা ২টো নাগাদ এগিয়ে থাকার খবর পান অভিজিৎ। তারপর ২ টো ৫০ নাগাদ স্ত্রী চিত্রলেখাকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই জিপ চালিয়ে মাইল দেড়েক দূরের গণনাকেন্দ্রে রওনা দেন তিনি। ম্যাকেঞ্জি মোড়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের দেখে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। কর্মী, সমর্থকরা সবুজ আবিরে রাঙিয়ে দেন দম্পতিকে। সেখান থেকে মিছিল করে গণনাকেন্দ্রে ঢোকেন অভিজিৎ। তৃপ্ত গলায় বলেন, “রাষ্ট্রপতি ভবনে দুপুরেই ফোন করে বাবাকে জয়ের খবর জানিয়েছি। বাবার নির্দেশ মতো জয়ের শংসাপত্র নিয়ে ফের সন্ধ্যায় ফোন করেছি। বাবা বলেছেন, মানুষের জন্য উন্নয়নের কাজ করে যেতে।”
সিপিএম অবশ্য জঙ্গিপুরে বাম প্রার্থীর পরাজয়কে অপ্রত্যাশিত বলেই মনে করছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য নিজে ২০০৯ সালে এই লোকসভা কেন্দ্রে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ১ লক্ষ ২৮ হাজার ভোটে হেরে গিয়েছিলেন। তবে ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জঙ্গিপুর ছিল বামেদেরই দখলে। মাঝে একবার কংগ্রেসের ইদ্রিশ আলি (তৃণমূলের জেলা সভাপতি মহম্মদ আলির বাবা) সামান্য ব্যবধানে জিতে জঙ্গিপুরে সাংসদ হন। বছর আড়াই পরে তাঁর মৃত্যু হলে আসনটি ফের দখল করে বামেরা। ২০০৪ সালে জঙ্গিপুরে দাঁড়িয়ে তাঁর জীবনের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে বামেদের কাছ থেকে আসনটি ছিনিয়ে নিয়ে জয়ী হন প্রণববাবু। মৃগাঙ্কবাবু বলেন, ‘‘জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদ এবারে সেফ সিট ছিল সিপিএমের কাছে। দু’টি আসনেই জয় নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম আমরা। তৃণমূল ও বিজেপি জঙ্গিপুরে বাম ভোটে যে থাবা বসিয়েছে তা আমরা বুঝতে পারিনি। তবে বহরমপুরে বামেরা যে ভাল ফল করতে পারবে না সেটা আগেই জানতাম আমরা।”
তৃণমূলের মন্ত্রী সুব্রত সাহা বলছেন, “জঙ্গিপুরের সামগ্রিক ফলাফল ভাল না হওয়ার কারণ খতিয়ে না দেখে বলা মুশকিল।” সুব্রতবাবু এমনটা বললেও তৃণমূল প্রার্থী শেখ নুরুল ইসলামের প্রধান নির্বাচনী প্রচার কর্তা তৃণমূলের রাজ্য কমিটির সদস্য শেখ ফুরকান বলেন, “জঙ্গিপুরে কংগ্রেস ও সিপিএমের মতো সংগঠন তৃণমূলের নেই। এই দুর্বলতার কারণেই জঙ্গিপুরে হার হয়েছে আমাদের। তবে এই অবস্থাতেও জঙ্গিপুরে তৃণমূল প্রার্থী যে ২ লক্ষ ৭ হাজার ভোট পেয়েছেন তা কিন্তু কম নয়।” বিজেপি ২০১২ সালের উপ নির্বাচনে ৮৫ হাজার (১০ শতাংশ) ভোট পেয়ে রাজ্য রাজনীতিতে রীতিমতো শোরগোল তুলে ছিল। কিন্তু এবারে মোদী হাওয়াতেও সেই ১০ শতাংশ ভোট ধরে রাখতে না পারায় জামানত জব্দ হয়েছে বিজেপি-র। এবারে ৯৬ হাজার ভোট পেয়েছে বিজেপি যা জঙ্গিপুরে ১১,১৯৩২০ পোলিং ভোটের ৮.৬ শতাংশ।