উদ্যোগী নদিয়া জেলা পুলিশ

দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে বিশেষ সেল

পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল প্রতিবেশী গোপাল রায়ের বিরুদ্ধে। হাঁসখালি থানায় অভিযোগ দায়ের হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়। আসামির পাঁচ বছরের কারাবাসের সাজা হয়। নয় বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল প্রতিবেশী সুশান্ত সরকারের বিরুদ্ধে। সেক্ষেত্রেও কালীগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করার আট মাসের মাথায় বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। আসামিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৫ ০০:৫৮
Share:

পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল প্রতিবেশী গোপাল রায়ের বিরুদ্ধে। হাঁসখালি থানায় অভিযোগ দায়ের হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়। আসামির পাঁচ বছরের কারাবাসের সাজা হয়। নয় বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল প্রতিবেশী সুশান্ত সরকারের বিরুদ্ধে। সেক্ষেত্রেও কালীগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করার আট মাসের মাথায় বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। আসামিকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

Advertisement

রাজ্যে নানা আদালতগুলিতে মামলা যখন জমে পাহাড়, তখন নদিয়া জেলায় বেশ কিছু মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে গত কয়েক মাসে। জেলার পুলিশের দাবি, এই কৃতিত্বের অনেকটাই তাদের। জেলার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলা বেছে নিয়ে সেগুলির উপর নজরদারি চালাতে একটি ‘ট্রায়াল মনিটরিং সেল’ গড়া হয়েছে। সেল-এর সদস্যদের উদ্যোগের জেরেই এমন দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে মামলার, বলছে পুলিশ। ইতিমধ্যেই ওই সেল-এর তত্ত্বাবধানে থাকা ২১টি মামলার রায় ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। তার ১৯টিতে সাজা পেয়েছে অভিযুক্ত।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আদালতের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগের অভাবে অনেক সময়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসাররা নির্দিষ্ট দিনে হাজির হতে পারেন না। বিচারকের কাছে ভর্ৎসিত হন। পুলিশের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টও জারি হয়ে যায়। যেমন মাস কয়েক আগে নির্দিষ্ট দিনে আদালতে হাজির না হওয়ায় নাকাশিপাড়ার ওসিকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন কৃষ্ণনগর জেলা আদালতের এক বিচারক। সময় মতো সাক্ষী বা আসামিকে হাজির না করায় মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে। আইনের ফাঁক গলে অনেক সময় আসামিরাও ছাড়াও পেয়ে যায়। তাই স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলি, বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের উপর অত্যাচার (পসকো আইন) ডাকাতি ও খুনের মতো ঘটনাগুলি যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, তার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। ‘ট্রায়াল মনিটিরিং সেল’-এর অধীনে নতুন পুরনো মিলিয়ে মোট ১২০টি মামলার একটি তালিকা করা হয়েছে। বর্তমানে সেই কেসগুলি কী অবস্থায় রয়েছে, কবে মামলার পরবর্তী তারিখ, সেই তারিখে কোন সাক্ষীকে আদালতে হাজির হতে হবে, কবে নথিপত্র জমা দিতে হবে, কবে থেকে শুনানি শুরু হচ্ছে সব খুিঁটনাটি বিষয়ের উপর নজর রাখার জন্য ওই সেল গড়া হয়েছে। জেলার পুলিশ কর্তাদের দাবি, জেলায় এমন বেশ কিছু মামলা পড়ে রয়েছে, যেগুলি অনেক পুরনো। সময়ে চার্জশিট জমা না দেওয়ার কারণে যেগুলি এখনও শুরুই করা যায়নি। সময়মতো চার্জশিট ও সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট, আদালতে জমা না দেওয়ার কারণে মামলা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বা কখনও মামলা দীর্ঘায়িত হয়েছে। জেলার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ জানান, অনেক সময় দেখা যায় শুধুমাত্র নজরদারির অভাবে মানুষ ন্যায্য বিচার পাচ্ছেন না। অনেক সময় বিচার পেতেও দেরি হচ্ছে। তিনি বলেন, “নথিপত্র জমা না দেওয়া বা সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে যাতে মামলার বিচার দীর্ঘ না হয়, তার জন্য তাঁদের এই উদ্যোগ।”

Advertisement

জেলা পুলিশ সূত্রে খবর, ডিএসপি (সদর) অভিষেক মজুমদারের নেতৃত্বে ওই সেলে রয়েছেন একজন এএসআই ও ছয়জন কনস্টেবল। রানাঘাট ও কৃষ্ণনগর জেলা আদালত ও রানাঘাটের মহকুমা আদালতের দু’জন ও কল্যাণী ও তেহট্ট মহকুমা আদালতে একজন করে কনস্টেবল প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি মামলা চলাকালীন সংশ্লিষ্ট এজলাসে উপস্থিত থেকে মামলার গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখছেন। সেই মতো তাঁরা সংশ্লিষ্ট মামলাগুলির বিস্তারিত বিষয় তাঁরা দফতরে এসে রিপোর্ট করেন। এর পর ওই সব মামলার খুঁটিনাটি বিষয় আপডেট করা হয় জেলা পুলিশের একটি নির্দিষ্ট সফট্ওয়্যারে। প্রতিটি মামলার এফআইআর কপি থেকে শুরু করে সমস্ত নথি রাখা আছে ওই সফট্ওয়্যারে। ওই সফট্ওয়্যারের মাধ্যমে প্রতিটি মামলার বর্তমান অবস্থা-সহ মামলার বিস্তারিত তথ্য পৌঁছে যায় জেলার পদস্থ পুলিশ কর্তাদের সামনে। তাঁরা ওই সফট্ওয়ারের মাধ্যমে ওই মামলাগুলির উপরে নজরদারি চালান। পাশাপাশি প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও তদন্তকারী আধিকারিককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে থাকেন। ওই মামলাগুলির আদালতে যেদিন তারিখ পড়ে, তার অন্তত দু’দিন আগে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও তদন্তকারী অফিসারকে সতর্ক করা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই মতো তাঁরা ওই মামলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এমনকী তাঁরা সাক্ষীকে সঙ্গে করে আদলতে হাজির হচ্ছেন। ফলে সাক্ষীর অভাবে মামলা দীর্ঘায়িত হচ্ছে না।

জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, প্রতিটি পুলিশ অফিসারের উপরে পাহাড়-প্রমাণ মামলার চাপ থাকে। সেই সঙ্গে এলাকার আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব তাঁকেই সামলাতে হয়। ফলে সবসময় মামলার খুঁটিনাটি মনে রাখা বা জমা রাখা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে পুরনো মামলার ক্ষেত্রে অনেক কিছুই তাঁদের হাতড়ে বেড়াতে হয়। তিনি বলেন, “সেই সমস্যা দূর করতে আমরা সংশ্লিষ্ট অফিসারকে সতর্ক করে দিচ্ছি। এবং সেই সঙ্গে ওই বিশেষ সফট্ওয়ারের মাধ্যমে তাঁরা যাতে মামলার খুঁটিনাটি তথ্যও সহজে হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছেন।”

তবে পুলিশের এই সক্রিয়তা মামলায় সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আইনজীবীদের কেউ কেউ। ফেডারেশন অফ বার অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক দেবাশিষ রায় বলেন, “পুলিশ দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে চাইছে এটা খুবই ভাল। কিন্তু দেখতে হবে যে অতি সক্রিয়তা ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায়।” বর্ষিয়ান আইনজীবী শ্যামাপ্রসাদ সিংহরায় বলেন, “ আসামিরা যাতে জামিন না পায় তার জন্য পুলিশ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চার্জশিট জমা দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু অনেকে ক্ষেত্রেই তা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। তাতে কোনও কোনও আসামিপক্ষ সুবিধা পেয়ে যেতে পারে।” তবে তিনি এও বলেন, “সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট যাতে দ্রুত জমা পড়ে সেদিকে যেন মনিটরিং সেল খেয়াল রাখে।”

তবে ওই মনিটরিং সেলের জন্য সুফল যে মিলছে তাও মানছেন কেউ কেউ। গত বছর অগস্ট মাসে দুষ্কৃতীদের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে খুন হয়েছিলেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ইন্দ্রনীল রায়। কৃষ্ণগঞ্জ জেলা আদালতে অ্যাডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর বিকাশ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এরই মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ। পুলিশ সাক্ষীদের সঙ্গে করে আদালতে নিয়ে এসেছিলেন। আশা করছি আগামী মাস ছয়েকের মধ্যে রায় ঘোষণা হয়ে যাবে।” ঘুঘড়াগাছিতে অপর্ণা বাগ হত্যা মামলাটিও মনিটিরিং সেলের তালিকায় রয়েছে। সেই মামলাটিও নজরদারির কারণে গতি পেয়েছে বলে দাবি তাঁর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন