চলছে পুতুল নাচের মহড়া। শিমুরালিতে তোলা নিজস্ব চিত্র।
এক সময় গ্রাম-গঞ্জে ঢেউ তুললেও আজ আর চাহিদা নেই। মাঝে-মধ্যে মেলা-উৎসবে ডাক পেলেও লোকজন হয় না মোটে। বিশ্বায়নের যুগে চরম দুর্দশায় পড়েছে বাংলার শতাব্দী-প্রাচীন পুতুল নাচ শিল্প। ভাল সময়ে নদিয়ার হাঁসখালি, ধানতলা-সহ কয়েকটি জায়গায় ৬০টির মতো পুতুল নাচের দল ছিল। এখন তা কমতে কমতে বারো-পনেরোতে এসে দাঁড়িয়েছে।
গ্রামবাংলায় পুতুল নাচ এসে পৌঁছেছিল সূদূর রাজস্থান থেকে। আগে দশ-পনেরো দিন তো বটেই, কোথাও কোথাও টানা এক মাস ধরে পুতুল নাচের আসর বসত। আর তাই দেখতে প্রতিদিন শয়ে-শয়ে মানুষ ভিড় করতেন। একই পালা দিনে দু-তিন বার হয়েছে, এমনও দিন গিয়েছে। কিন্তু আজ চিত্রনাট্যটা সম্পূর্ণ উল্টো। নিয়মিত বায়না হয় না। পেট চালানোর জন্য তাই শিল্পীদের অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগের প্রধান তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘ভবিষ্যৎ না থাকায় কেউই নতুন করে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন না। এমনকী শিল্পীদের পরিবারের লোকেরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ভালবেসে কিছু মানুষ এখনও পুতুল নাচ এখানে-ওখানে দেখান। কিন্তু যা উপার্জন হয়, তাতে পেট ভরে না।”
এদিকে, পুতুল নাচের দল টিকিয়ে রাখার জন্য খরচ হয় প্রচুর। একটা দলে কমপক্ষে ৭০-৮০টা পুতুল রাখতে হয়। শোলা দিয়ে পুতুলগুলি তৈরি করতে খরচ হয় দেড় থেকে দু’হাজার টাকা। তিন-চার বছর অন্তর সেগুলি রং করতে হয় নিয়মিত। এছাড়াও রয়েছে গাইয়ে, নাচিয়ে, যন্ত্রবাদকদের পারিশ্রমিক। রয়েছে মঞ্চসজ্জা, আলোকসজ্জার খরচ। এত কিছু সামলাতে না পারায় সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে হারিয়ে গিয়ে একটি-একটি করে দল। পরিবর্তনের জমানায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়েছে। লোকশিল্পীদের পরিচয়পত্র (আর্টিসান কার্ড) দেওয়া হচ্ছে। আর্থিক সাহায্যও করা হয়েছে। তারপরেও যে পুতুল নাচের দলগুলির হাল ফেরানো যায়নি তা মেনে নিয়েছেন নদিয়া জেলার তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক গিরিধারী সাহা। তিনি বলেন, “জেলার কয়েকটি দলকে আর্থিক সাহায্য করা হয়েছিল। কয়েকজনকে লোকশিল্পীর পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। সরকারি সচেতনতা প্রচারে পুতুল নাচকে ব্যবহারও করা হচ্ছে। কিন্তু লোক না হলে কী আর করা যাবে।’ এক পুতুল নাচ দলের গাইয়ে কানাই দাস হতাশ গলায় বলেন, ‘‘এক সময় পুতুল নাচের জন্য সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যেত। যাত্রা হবে বলে পুতুল নাচ বন্ধ রাখার জন্য আমাদের অনুরোধ করা হত। আজ সেসব দিনের কথা মনে পড়লে কষ্ট হয়।”
কিছু দিন আগে চাকদহ থানার শিমুরালীর সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘সৃজনী’ আয়োজিত পুতুল নাচ রাজা হরিশ চন্দ্র এবং ‘আমরা কজন’-এর হাস্যকৌতুক দেখতে অবশ্য ভালই ভিড় হয়েছিল। দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পুতুল নাচ দেখতে এসেছিলেন স্থানীয় তেলিপুকুরের বাসিন্দা বিমল পাল। বেসরকারি সংস্থার কর্মী বিমলবাবু বলেন, “আমরা ছোটবেলায় অনেক পুতুল নাচ দেখলেও এখন সেই সুযোগ নেই। তাই পুতুল নাচ হচ্ছে শুনে ছেলেদের নিয়ে এসেছি।’’ সৃজনীর সম্পাদক প্রদীপকুমার সরকার বলেন, ‘‘হারিয়ে যেতে বসা শিল্পসংস্কৃতিগুলি মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি। মানুষ ভাল সাড়াও দেয় এতে।’’