বিকট একটা আওয়াজ। সেই সঙ্গে একজনের আর্ত চিৎকার। মাঝবয়সী এক ভবঘুরে পড়ে রয়েছেন ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে। বাঁ পায়ের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে দ্রুতগামী গাড়ি। ঘটনার পরে ভিড় জমতে খুব বেশি সময় লাগেনি। আবার অহেতুক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ায় ভয়ে সেই ভিড়টা ফাঁকাও হয়ে গিয়েছিল মুহূর্তেই। তবে আর পাঁচ জনের মতো মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে পারেননি শুধু আলতাফ হোসেন। মুর্শিদাবাদের মোড়গ্রাম এলাকায় জাতীয় সড়কের পাশের একটি ধাবার মালিক আলতাফের উদ্যোগেই প্রাণ ফিরে পেলেন চালচুলোহীন ওই ভবঘুরে।
পথেঘাটে মুখ থুবড়ে পড়ে থেকে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে দেখা যায় অনেক অসহায়কে। পুলিশি ঝামেলার ভয়ে তাঁদের প্রতি সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে দেওয়াটাই এখন দস্তুর। এমনকী হাসপাতালের দোরগোড়ায় অসুস্থ ভবঘুরেকে বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকতে দেখাটাও এখন অস্বাভাবিক নয়। প্রত্যাখাত হয়ে তিন তিনটি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে বেসরকারি হাসপাতালে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাও এখন নজিরবিহীন নয়। সেই নিদারুণ অভ্যাসের মাঝেই দৃষ্টান্তমূলক ব্যতিক্রমী নজির গড়লেন আলতাফ। মুশির্দাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারি সুপার বিজয় ভৌমিক বলেন, “এই কৃতিত্বটা আলতাফেরই। এমন মানুষ আজকের দিনে সত্যিই বিরল।”
বছর পঞ্চান্নর ওই ভবঘুরে হাসপাতালে তাঁর নাম বলেছেন সুব্রত রায়। বাড়ি দুর্গাপুর। এর বেশি তিনি কিছু বলতে পারেননি। বছর কয়েক ধরে ওই ভবঘুরেকে সাগরদিঘির মোড়গ্রাম মোড়েই ঘুরতে দেখেছেন স্থানীয় লোকজন। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ওই মোড়টি আদতে একটি ছোটখাটো গঞ্জ। সেই গঞ্জের কোনও দোকানের চালার নীচে ওই প্রৌঢ়ের রাত কাটে। খুন্নিবৃত্তি মেটে ব্যবসায়ীদের দয়ায়। গত ১৮ ডিসেম্বর রাত ৮টা নাগাদ ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনার পরে ওই দৃশ্য দেখে অনেকেই পিঠটান দেন। ব্যতিক্রম শুধু আলতাফ।
আলতাফ বলছেন, “রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। লোকটার হাঁটুর নীচ থেকে পায়ের হাড় ভেঙে গুড়ো হয়ে গিয়েছে। শুধু মনে হয়েছিল, দেরি করলে আর বাঁচানো যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ডেকে সুব্রতবাবুকে নিয়ে সোজা চললাম মুশির্দাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।” মুশির্দাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সুপার মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “একজন অপরিচিত ভবঘুরের জন্য আজকের দিনে কেউ যে এতটা করতে পারেন তা আলতাফ হোসেনকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ৩৫ কিলোমিটার দূর থেকে হাসপাতালে এসে প্রতিদিন রোগীর দেখভালের পাশাপাশি কী ভাবে প্রৌঢ়কে সুস্থ করে তোলা যায় তা নিয়ে প্রতিদিন চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করেন।”
গত মঙ্গলবার ৩ ঘণ্টা ধরে অস্ত্রোপচার করা হয়। মুশির্দাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অস্থি বিভাগের প্রধান তথা অধ্যাপক সন্দীপ ঘোষের নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেন। সন্দীপবাবু বলেন, “ওই রোগীর চিকিৎসার সব ভার আমরা চিকিৎসকরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিই। হাড় জোড়া দেওয়া হয় ৪ টে পিন, ক্লাম ও একটি খাঁচার সাহায্যে। চিকিৎসা বিজ্ঞনের ভাষায় একে বলে ‘এক্সটারনাল ফিক্সেশন’। সুস্থ হয়ে উঠতে সময় লাগবে। তবে তিনি এখন বিপন্মুক্ত।” সেই সুসংবাদে খুশি আলতাফ বলছেন, “চিকিৎসকদের আন্তরিক উদ্যোগে চালচুলোহীন মানুষটা নতুন জীবন পেলেন। তাতেই আমি খুশি। আর একজনের বিপদের সময় পাশে দাঁড়াতে গেলে অতশত ভয় পেলে চলে নাকি!”