পুজোর আগে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে রানাঘাট থেকে বহরমপুর যাওয়ার পথে এতদিন নাকে আসত একটাই গন্ধ। পাট পচানোর গন্ধ। রাস্তার ধারে নয়ানজুলিতে মাইলের পর মাইল জুড়ে পচত পাট। সেই গন্ধ এখন বদলে গিয়েছে। একটু সন্ধ্যা নামলেই ভেসে আসে রজনীগন্ধার মিষ্টি গন্ধ। আর দিনে দেখা যায়, দু-ধারের ফুল খেতে জমাট রোদ্দুরের মতো হলুদ গাঁদা।
রাজ্যে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক চটকল, বাজারে পাটের চাহিদা কমছে। নদিয়ার চাষিরা তাই পাটের জমিতে ফুল চাষ করছেন। গত পাঁচ বছরে রাজ্যে ফুল চাষের এলাকা বেড়েছে প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর। অন্য দিকে, রাজ্য কৃষি দফতরের এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গত বার পাট চাষ হয়েছিল ৫ লক্ষ ৭০ হাজার হেক্টরের কিছু বেশি জমিতে। এ বার চাষের জমি ৫ লক্ষ হেক্টরও ছোঁয়নি। নদিয়া-মুর্শিদাবাদ দক্ষিণবঙ্গে পাট চাষের প্রধান এলাকা। সেখানকার বহু চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা যে জমিতে পাট চাষ করতেন, সেখানে লাগাচ্ছেন ফুল।
করিমপুর কৃষিকল্যাণ সমিতির সম্পাদক বিশ্বনাথ বিশ্বাস বলেন, “চাকদহ, রানাঘাট, কল্যাণীর বিস্তৃত এলাকার চাষিরা পাট থেকে ঝুঁকেছেন ফুলের দিকে।” তাঁর হিসেব, পাট চাষে এখন বিঘে প্রতি খরচ ছ’হাজার থেকে সাড়ে ছ’হাজার টাকা। যা উৎপাদন হয়, তা থেকে হাজার চারেক টাকার বেশি মেলে না। অর্থাৎ বিঘে প্রতি হাজার দুয়েক টাকা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে চাষির। সেখানে ফুল চাষ করলে গোড়ায় বিনিয়োগ হয় একটু বেশিই, বিঘে প্রতি প্রায় ৩০ হাজার টাকা। তবে একবার উৎপাদন শুরু হলে এক বিঘে জমির ফুল ৬০-৭০ হাজার টাকা তো বটেই, লক্ষাধিক টাকাতেও বিক্রি হয়।
একই কথা বললেন নদিয়ার চাপড়ার আনোয়ার শেখ। বছর কয়েক আগেও পাট চাষ করতেন তিনি। এখন ফুল চাষ করছেন। আনোয়ার বলেন, “আমাদের গ্রামে আগে যাঁরা পাট চাষ করতেন তাঁদের অনেকেই এখন ফুল, সব্জি, কলা চাষ করছেন।” তিনি জানান, পাট জমি থেকে তোলার পরেও একটা দীর্ঘ পরিশ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া রয়েছে। পাট পচিয়ে, ছাড়িয়ে বিক্রির উপযুক্ত করতে মাস খানেক সময় লাগে, শ্রমিকের জন্য মজুরি লাগে। কৃষ্ণনগরের হরিশপুরের চাষি মিলন বিশ্বাস বলছেন, “এক বিঘা জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ করছি। আগে জমিতে পাট চাষ করতাম। পাটের থেকে ফুলে দ্বিগুণের বেশি লাভ পাচ্ছি। ”
নদিয়ার উদ্যানপালন আধিকারিক রাহুল মারিক জানান, বছর পাঁচেক আগে ‘প্রোজ্জ্বল’ নামে সংকর প্রজাতির রজনীগন্ধা চাষ শুরু হয় নদিয়ায়। সহনশীল এবং উচ্চ উৎপাদনশীল হওয়ায় তার চাষ দ্রুত ছড়িয়েছে। এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে মুর্শিদাবাদেও ওই প্রজাতির রজনীগন্ধার চাষ শুরু হয়েছে, জানালেন মুর্শিদাবাদের উদ্যানপালন আধিকারিক গৌতম রায়। ফার্মার্স ক্লাব, স্বনির্ভর গোষ্ঠীদেরও ফুল চাষে উৎসাহ দিতে জাতীয় হর্টিকালচারাল মিশন ‘প্রোজ্জ্বল’ চারা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে, ‘পলিহাউস’ পদ্ধতিতে সারা বছর চাষের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। গোড়ায় বিনিয়োগ বেশি হলেও, পরে এতে লাভের মুখ দেখছেন চাষি।
বিশ্বনাথবাবু জানান, বিধানচন্দ্র কৃষি বিদ্যালয় থেকে জৈব কীটনাশক, জৈব সার পাচ্ছেন চাষিরা। ছোট টিউবওয়েলের সাহায্যে ‘মাইক্রো-ইরিগেশন’ প্রযুক্তিতে সেচ, যন্ত্রের ব্যবহার করে চাষের জমি তৈরি, এমন নানা নতুন প্রযুক্তি শিখছেন। ফুল কাটিং, বাছাই, মান অনুসারে বিন্যাসের পদ্ধতিও শিখছেন। ফুল চাষ করলে রাজ্য সরকার চাষিদের উৎসাহ ভাতাও দিচ্ছে, জানালেন রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যান পালন দফতরের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী।
নদিয়া-মুর্শিদাবাদে কত চাষি ফুল চাষ করছেন, কত জমি এসেছে ফুল চাষের অধীনে, তার নির্দিষ্ট হিসেব নেই উদ্যান পালন দফতরের কাছে। তবে ফুল চাষ যে বাড়ছে তার ইঙ্গিত মেলে নতুন নতুন ফুলের বাজার তৈরি থেকে। বেথুয়াডহরি, কৃষ্ণনগর, বাদকুল্যা, কালীনারায়ণপুরে ফুল বাজার বাড়ছে। নোকারি, পূর্ণনগর, ধানতলার বাজার তো রয়েইছে। বাজার জমে উঠেছে বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, জিয়াগঞ্জে। বিশেষ পদ্ধতিতে প্যাকেজিং হয়ে এই সব বাজার থেকে ফুল উত্তরবঙ্গ, বাংলাদেশ, হাওড়ার মল্লিকঘাট যাচ্ছে। ভিনরাজ্যেও যাচ্ছে।
ফুল সংরক্ষণের জন্য নদিয়া জেলা পরিষদ রানাঘাটে তৈরি করেছে আধুনিক হিমঘর। রানাঘাটে ফুল নিলামের বাজারও গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে উন্নত মানের ফুল চলে যাচ্ছে কলকাতায়। রফতানিও হচ্ছে অন্যান্য রাজ্যে। তুলনায় কম মানের ফুল স্থানীয় বাজারেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করেই কখনও ফুল লাগাচ্ছেন চাষিরা। কখনও ফুল উৎপাদনের পরে চুক্তি করছেন। কোনও কোনও চাষি নিজেরাই বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন ফুল।তবে পরিকাঠামোর অভাব থেকেই যাচ্ছে। বাসে বা ট্রাকে ফুলের মতো নরম পণ্য আনা কঠিন। দরকার রেল পরিবহণ। কিন্তু এই এলাকার মানুষের দীর্ঘ দিনের চাহিদা সত্ত্বেও কৃষ্ণনগর-করিমপুর-বহরমপুর রেল লাইন তৈরি হয়নি। “না হলে স্ট্রবেরি, আপেল কুলের মতো দামি ফল চাষ করা যেত পাটের জমিতেই,” আক্ষেপ করলেন বিশ্বনাথ বিশ্বাস।