পুলিশ হেফাজতে সঞ্জয় বসু। —নিজস্ব চিত্র।
প্রায় দেড় কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে এক অর্থলগ্নি সংস্থার কর্তাকে গ্রেফতার করল নবদ্বীপ থানার পুলিশ। ধৃতের নাম সঞ্জয় বসু। তাঁর বাড়ি হাওড়া জেলার সাঁকরাইলের বাণীপুরে। শনিবার নবদ্বীপ এলাকা থেকেই সঞ্জয়বাবুকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি পি আর গ্রুপ অফ কোম্পানি নামে এক লগ্নি সংস্থার অন্যতম ডিরেক্টর।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে ২০১২ সালে নবদ্বীপের হরিসভা পাড়ায় অফিস খুলে ব্যবসা শুরু করে সংস্থাটি। স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রকল্পে চড়া হারে সুদের প্রলোভন দেখিয়ে মাত্র এক বছরের মধ্যে নবদ্বীপ শহর এবং সংলগ্ন গ্রামীণ এলাকা থেকে ১ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকার আমানত সংগ্রহ করে। মাত্র এক বছরের জন্য রেকারিং বা ফিক্সড ডিপোজিটে টাকা রাখলে ১৭.৫ থেকে ১৪.৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। অল্প সময়ে ভাল সাড়া পাওয়ায় সংস্থার নবদ্বীপ শাখায় প্রায় শতাধিক এজেন্ট নিয়োগ করা হয়। বিনিয়োগের সময় সীমা এক বছর হওয়ায় প্রকল্পে বহু মানুষ টাকা জমা রাখেন। কিন্তু ঠিক এক বছরের মাথায় আমানতের মেয়াদ পূর্ণ হতেই কোম্পানির স্বরূপ প্রকাশ পায়।
এজেন্ট এবং আমানতকারীরা পাওনার জন্য অফিসের উপর চাপ বাড়াতেই ২০১৩ সালে অক্টোবর মাসে বন্ধ হয়ে যায় নবদ্বীপ অফিসের ঝাঁপ। ততদিনে নবদ্বীপের শাখায় জমা পড়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। এদের মধ্যে নবদ্বীপের বাসিন্দা নিখিল কর্মকার ১৫ লাখ টাকা, স্বরূপগঞ্জের সুজিত দেবনাথ ১৪ লাখ টাকা, বিদ্যানগরের অমিত কুণ্ডু ৫ লাখ টাকা, ধীমান কুণ্ডু, জয়ব্রত দাস ৩ লাখ করে টাকা বিনিয়োগ করেন। আবার ললিতা কুণ্ডুর মতো ছোট ব্যবসায়ী সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে কেনা জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন সংস্থার এজেন্টের হাতে। নিখিলবাবু, সুজিতবাবুরা জানান, অফিস বন্ধ হওয়ার পরে তাঁরা সংস্থার কর্তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। শুনেছেন অভয়বাণী ‘আমরা সারদা নই, ভয় পাবেন না’। কখনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চেক দিয়েছেন। সে সবই যথা সময় বাউন্স করেছে।
২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেলে প্রথম কয়েক মাস প্রতারিতরা টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ স্তরে যোগাযোগ করেন। কিন্তু সংস্থার কর্তারা কার্যত কোন কিছুকেই পাত্তা দেননি। ২০১৪ সালের অগস্ট মাসে প্রথম অভিযোগ জানানো হয় পুলিশের কাছে। ফল না মেলায় আদালতের দ্বারস্থ হন। প্রতারিতদের আইনজীবী বিকাশ মণ্ডল বলেন, “সেপ্টেম্বরে ২৮ জন এজেন্ট ও আমানতকারী নবদ্বীপের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে সংস্থার মোট সাত জন ডিরেক্টরের নামে প্রতারণা এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। বিচারক পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দিলে ময়দানে নামে পুলিশ। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ সিআরপিসি-র ৪১ ধারা মতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হওয়ার নোটিস জারি করলেও তাঁরা কেউ আসেননি।”
২৫ ফেব্রুয়ারি নবদ্বীপ থানার পুলিশ কয়েকজন আমানতকারীকে নিয়ে চন্দননগরের খলিসানি বিশালক্ষি তলায় সংস্থার অন্যতম প্রধান দুই কর্তার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গেলে বাধার মুখে পড়েন। আইনজীবী বিকাশ মণ্ডল অভিযোগ করেন, পুলিশি তল্লাশিতে বাধা দিয়েছিলেন চন্দননগর পৌরসভার এক বরো চেয়ারম্যান। তিনি লোকজন নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পুলিশকে আটকে রাখেন। ফলে ওই দুই অভিযুক্ত পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। তবে বহু কাগজপত্র, ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত হয়। বিকাশবাবু জানান, ওই বরো চেয়ারম্যানও এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত। এমনই অভিযোগ জানিয়ে তাঁকেও গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়েছে আদালতের কাছে।
মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগণা জেলা জুড়ে পি আর গ্রুপ এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছ’শো কোটি টাকার ব্যবসা করেছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। নবদ্বীপের আইসি তপনকুমার মিশ্র বলেন “শনিবার সঞ্জয় বসু তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু তদন্তকারীরা তাতে সন্তুষ্ট হননি। তাই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।” নবদ্বীপ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি নবেন্দু মণ্ডল বলেন, “ধৃতের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০, ৪০৬, ৪৬৭, ৪৬৮, ১২০বি এবং ৩৪ ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। দশ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন।”