ছিল আস্ত একটা পুকুর। কিন্তু রাতারাতি হয়ে গেল ভিটেমাটি। সৌজন্যে, এলাকার জমির কারবারের সঙ্গে জড়িত অসাধু প্রোমোটারদের কারসাজি।
নাকাশিপাড়া ব্লকের বেথুয়াডহরী-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন ৪৬ নম্বর পশ্চিম জগদানন্দপুর মৌজার অধীন ৫১২ নম্বর দাগ নম্বরে ১ একর ৩৬ শতক জলা জমি ছিল। বিঘে দশেকের ওই জমিতে বহুদিন আগে একটি পুকুর ছিল। এলাকাবাসীর কাছে যা ‘গাঙ্গুলী পুকুর’ নামে পরিচিত ছিল। এখন ওই জমির মধ্যে মেরেকেটে বিঘে খানেক অংশে অগভীর পুকুর রয়েছে। বাকিটা জমি-মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে বুজে গিয়েছে। ভূমি ও ভূমি-সংস্কার দফতরের হিসেবে, ওই জমির সিংহভাগেরই চরিত্র এখন আমন অর্থ্যাত্ চাষযোগ্য। রাতের অন্ধকারে লোকজন নিয়ে গাড়ি ভর্তি মাটি ফেলে ওই পুকুর বুজিয়ে দিচ্ছে জমির কারবারীরা। ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয় জনা তিরিশ বাসিন্দা ব্লক থেকে শুরু জেলা প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ কর্তার ও জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। কিন্তু অভিযোগের পর কিছু দিন বন্ধ থাকলেও আবার শুরু হয় পুকুর ভরাট।
নাকাশিপাড়া ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রায় আড়াই দশক আগে ওই পুকুরের মালিক ছিলেন সুখময় গঙ্গোপাধ্যায়। পরে তিনি ওই পুকুর বিক্রি করেন প্রবোধ ঘোষ নামে এলাকারই এক ব্যক্তিকে। ২০১২ সালে প্রবোধবাবু ওই জলাজমি বিভিন্ন লোককে অল্প অল্প করে বিক্রি করে দেন। ব্লক ভূমি সংস্কার দফতরের তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে ওই জমির মালিকানা রয়েছে প্রায় ৫০ জনের নামে। তেমনই দু’জন তপন দত্ত ও চিত্ত ঘোষ। তাঁরাও স্থানীয় বাসিন্দা। এলাকায় প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ওই দু’জনেই জমির বেশি অংশ কিনেছিলেন। ওই জলাজমি কেনার পর তাঁরা মাটি ফেলতে থাকেন বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি। দিনকয়েক আগে এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, পুকুরের সেভাবে কোনও নামগন্ধ নেই। বেথুয়াডহরী-পাটুলি ঘাট রোডের ধারের ওই জমির মাত্র কাঠা দশেকে রয়েছে জল। বেশিরভাগ অংশই মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। কিছু কিছু অংশে আবার কংক্রিটের বাড়ি বা দোকান ঘর করা হয়েছে। মাটি ফেলে অন্তত দশ ফুট উঁচু করা হয়েছে ওই জমি। স্থানীয় বেথুয়াডহরী-১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ প্রধান মনোরঞ্জন মালাকার বলেন, “বেছে বেছে লোকসভা ভোটের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধকালীন তত্পরতায় মাঝরাতে ওই প্রোমোটাররা পুকুর বুজিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, অন্য সময়েই রাতের দিকে ওঁরা দলবল নিয়ে ওই জমিতে মাটি ফেলে। প্রতিবাদ করেও কোনও ফল হয় না।”
এর প্রতিবাদে স্থানীয় লোকজন নাকাশিপাড়ার বিডিও, মহাকুমা শাসক (সদর), অতিরিক্ত জেলা শাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার), নদিয়ার জেলা শাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়েরও করেছেন। নালিশ জানানো হয়েছে জেলা মত্স্য দফতরেও। অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করে বিডিও হেমন্ত ঘোষ মহকুমা শাসকের কাছে রিপোর্ট পাঠান। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে মহকুমা শাসক ওই জমির উপর ১৪৪ ধারা জারি করেন। ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর জারি করা ওই ১৪৪ ধারায় পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে, “ওই জমি সংক্রান্ত চূড়ান্ত নির্দেশ জারি না হওয়া পর্যন্ত কোনওরকম নির্মাণ করা যাবে না। সেই সঙ্গে ওই জমির আশপাশে কেউ সমবেত হতে পারবে না। কোনওরকম মাইক ব্যবহার করে ওই জমি নিয়ে কেউ কোনও বক্তব্যও পেশ করতেও পারবেন না। নির্দেশ কার্যকর করতে হবে ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক ও নাকাশিপাড়া থানার ওসিকে।’’ সেই মত নাকাশিপাড়া ব্লকের তরফে ওই জমিতে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। সেখানে ওই জমিতে কোনওরকম হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় লোকজন-সহ বেথুয়াডহরী-১ নম্বর পঞ্চায়েতের বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের পুলক সিংহের ক্ষোভ, “টাঙানোর কিছু দিনের মধ্যেই ওই সাইনবোর্ড খুলে জলে ফেলে দেওয়া হয়। তারপর গায়ের জোরে আবার ওঁরা ওখানে মাটি ফেলেছে।” হেমন্তবাবু বলেন, ‘‘সরকারি নির্দেশ অমান্য করা হচ্ছে। আমাদের টাঙানো সাইন বোর্ডও খুলে ফেলা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বজায় থাকছে না।” জেলার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “বিষয়টি এখনও নজরে আসেনি। খোঁজখবর নিয়ে দেখছি।” মনোরঞ্জনবাবুরও হতাশা, “বৃষ্টির অতিরিক্ত জল ওই পুকুরে জমা হত। এলাকার প্রতিমা বিসর্জনের একমাত্র আধার ছিল ওই পুকুর। কিন্তু এ ভাবে ভরাট করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে।”
শুধু সদর মহকুমা শাসকই নন, ওই জলা জমি ভরাটের ব্যাপারে পদক্ষেপ করেছে মত্স্য দফতরও। ‘ইনল্যান্ড ফিসারিজ আইন’ (১৯৮৪) অনুযায়ী, কোনওভাবেই পুকুর ভরাট করা যায় না। ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মত্স্য দফতরের সহকারী অধিকর্তাও ওই পুকুর ভরাট বন্ধের আর্জি জানিয়ে স্থানীয় নাকাশিপাড়া থানার ওসির কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারিস্তরে এত চিঠিচাপাঠির পরও পাল্টায়নি পরিস্থিতি। মাঝেমধ্যেই রাতের অন্ধকারে শোনা যায় মাটি ফেলার শব্দ। থামেন না প্রোমোটাররা। অভিযোগ, প্রশাসনের একাংশের মদতে চলছে এ কাজ। অভিযুক্ত তপন দত্ত অবশ্য বলছেন, “আমি মাটি ফেলিনি।’’ তাহলে আপনার জলা জমি সমান হল কীভাবে? কোনও উত্তর দিতে পারেননি তপনবাবু।