ক্লাস ফাইভ থেকে দু’জনেই সহপাঠী। বছরভর বন্ধুত্ব। পরীক্ষার সময়ই শুধু প্রতিযোগিতার লড়াই। সেই লড়াইয়ে কখনও এগিয়ে মহুল, কখনও অমর্ত্য। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বেরোতেই কল্যাণী এক্সপেরিমেন্টাল হাইস্কুলের দুই ছাত্রের মুখে চওড়া হাসি। মাত্র তিন নম্বরের ফারাক। তবু তো দু’জনই দশের মধ্যে। কল্যাণী চিত্তরঞ্জন পার্কের বাসিন্দা, পেশায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক মানবেন্দ্র পোদ্দারের ছেলে মহুল। এ বারের উচ্চ মাধ্যমিকে সপ্তম স্থানাধিকারী। তার প্রাপ্ত নম্বর ৪৭০। আর বি-১০ এর বাসিন্দা অমরকান্তি আচার্যর ছেলে অমর্ত্য। ৪৬৭ নম্বর পেয়ে সে দশ নম্বরে।
সকাল থেকেই দুই বাড়িতে মিষ্টির ছড়াছড়ি। আত্মীয় পরিজনের ফোনের ঠেলা সামলাতে সামলাতেই সংবাদমাধ্যমের কাড়াকাড়িতে হাইজ্যাক হয়ে টিভি চ্যানেলগুলোর স্টুডিওয় বসে পড়তে হয়েছে ওদের। কী পড়লে, কেমন পড়লে, তার খতিয়ান দিতে হয়েছে। যখন ছাড়া পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ওরা, তখন সন্ধ্যা। দু’বছরের কঠিন অধ্যাবসায়ের ফল হাতে পেয়েও অনুভব করার ফুরসত মেলেনি দু’জনেরই।
কী করে হল এমন ফল? মহুল, অমর্ত্য দু’জনেই বলে, “নির্দিষ্ট ভাবে কখনও ঘড়ি বেঁধে পড়িনি। আট-ন’ঘন্টা পড়তাম। যখন সুবিধা। কখনও রাত জেগে বা ছুটির দুপুরে।” দু’জনেরই প্রিয় খেলা ক্রিকেট। প্রিয় দল কেকেআর। আইপিএল নিয়ে দু’জনেই মোহগ্রস্ত। আর শাহরুখের প্রতিও। ‘বাজিগর’ থেকে ‘রা-ওয়ান’, বাদ যায়নি কোনও ছবি। ছোট গল্প পছন্দ দু’জনেরই। পড়ার বইয়ের শব্দগুলো মাথায় জট পাকালে গল্পের বই-ই সেরা দাওয়াই, মনে করে দুই বন্ধু।
মহুলের স্বপ্ন ইলেকট্রিক্যাল বা ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার। অমর্ত্য চিকিৎসক হতে চায়। জয়েন্ট দিয়েছে দু’জনেই। ভালো রেজাল্টেরও আশা করছে। দু’জনেরই উত্তর, “উচ্চমাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিতে নিতেই তো জয়েন্ট দেওয়া। যত ভালো উচ্চ মাধ্যমিকে আশা করেছিলাম তার থেকেও কিছুটা ভাল যখন হল, জয়েন্টটাও দেখাই যাক।”
বায়োলজি পছন্দের বিষয় অমর্ত্যর। ইংরেজি সাহিত্যও ভালো লাগে। বাবা-মার অনুপ্রেরণাই ছিপছিপে চেহারার অমর্ত্যর সবচেয়ে বড় পাথেয়। কল্যাণী স্বাস্থ্য নগরী বলে পরিচিত। কিন্তু এই শহরেই রাত-বিরেতে চিকিৎসকের খোঁজ করলে হাসপাতাল বা নাসির্ংহোমে নিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা! কল্যাণীর মানুষও আশা ছেড়ে দিয়েছেন। অমর্ত্য চিকিৎসক হতে চায় সেই মানুষগুলোর জন্য, যাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। “এটাই আমার স্বপ্ন,” অমর্ত্য বলে।
স্কুলের শিক্ষকদেরও পাখির চোখ ছিল মহুল আর অমর্ত্যর উপর। “মাধ্যমিকেও ভাল রেজাল্ট ছিল দু’জনের। উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টে অমর্ত্যই প্রথম হয়েছিল” বলেন, প্রধান শিক্ষক তাপসনারায়ণ বিশ্বাস। সকালবেলা ফল ঘোষণার পর স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় আপ্লুত হয়ে প্রিয় দুই ছাত্রকে শুভেচ্ছা জানান। স্কুল যে তাদের সম্বর্ধনা দেবে সে কথাও উল্লেখ করেন। কল্যাণী পুরসভার চেয়ারম্যান নীলিমেশ রায়চৌধুরীও বলেন, “ওরা তো আমাদের গর্ব। ওদের জন্য, ওদের পাশে আমরাও আছি।”
অন্যদিকে, সোদপুরের বাসিন্দা রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র সাগ্নিক চক্রবর্তীর বাড়িতেও এ দিন উৎসবের মেজাজ। সাগ্নিক এবার উচ্চ মাধ্যমিকে নবম স্থানাধিকারী। তার প্রাপ্ত নম্বর ৪৬৮। সাগ্নিকের মা ইংরেজির শিক্ষিকা। ছেলেকে তিনিই পড়াশোনা দেখিয়েছেন পরীক্ষার আগে। সাগ্নিকও মহুল, অমর্ত্যর মতো ধরাবাঁধা নিয়মে পড়ায় বিশ্বাসী নয়। রেফারেন্স বই, ইন্টারনেট, পাঠ্য বিষয়ের বাইরের বইও মেধাবৃদ্ধিতে সাহায্য করে, মনে করে সাগ্নিক। নিজে ছবি আঁকে, কবিতা লেখে। তবে নিজের লেখা কবিতা বলতে অস্বস্তি হয়। সাগ্নিক বলে, “আমি আমার মতো করেই বড় হয়েছি, লেখাপড়া করেছি। কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। আসল কথা হল, পড়তে ভাল লাগা।”