উদ্ধার করা সেই মুদ্রা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
একশো দিনের কাজে গ্রামের এক মন্দির সংলগ্ন জমির মাটি কাটতে গিয়ে উঠে এল ব্রিটিশ ভারতের মুদ্রা। মঙ্গলবার দুপুরে মায়াপুর বামুনপুকুর ১ পঞ্চায়েতের বল্লালদিঘি গ্রামে রামসীতা মন্দির সংলগ্ন এলাকায় একশো দিনের প্রকল্পে মাটি কাটার কাজ চলছিল। ফুট দেড়েক মাটি কাটার পরই গজেন হালদার নামে এক শ্রমিকের কোদাল শক্ত কিছুর সঙ্গে ঘা খায়। ইট মনে করে সেটিকে তুলতে গেলে গজেনবাবু একটি মাটির ভাঁড়ের মতো পাত্র পান। ওই পাত্রের ভিতরে ছিল মুদ্রাগুলি। বিকেলের পর থেকে মায়াপুর বামুনপুকুর জুড়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে বল্লালদিঘিতে মাটি থেকে মোহর উঠেছে। বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় মায়াপুর ফাঁড়ির পুলিশ। পরে নবদ্বীপের বিডিও এবং আইসি-র উপস্থিতিতে উদ্ধার হয় মুদ্রা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মুদ্রা বিশেষজ্ঞ সুস্মিতা বসু মজুমদার বলেন, “মুদ্রাগুলি ব্রিটিশ ভারতের আমলের। নানা ধাতুর সংমিশ্রণে এমন মুদ্রা তখন প্রচলিত ছিল। এমন মুদ্রা আগেও নানা জায়গা থেকে পাওয়া গিয়েছে।”
নবদ্বীপের বিডিও বিক্রম চট্টোপাধ্যায় বলেন, মোট ৩৭টি মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে ১৮৩৫ সালের দু’টি, ১৮৪০ সালের ১৮টি এবং ১৮৬২ সালের ১৭টি মুদ্রা রয়েছে। মুদ্রাগুলির অর্থমান হল এক টাকা, হাফ রুপি, ১/৪ রুপি এবং ২ আনা। নবদ্বীপের আইসি তপনকুমার মিশ্র জানিয়েছেন, ওই হাঁড়ি থেকে প্রথমে ৩৬টি মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। পড়ে আরও এক শ্রমিক একটি মুদ্রা দিয়ে যায়। এলাকায় নজরদারির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, এই বল্লালদিঘি গ্রামেই রয়েছে বল্লালঢিপি। দীর্ঘদিন সেটিকে রাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ বলে মনে করা হত। কিন্তু ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বল্লালঢিপি খনন করলে দেখা যায় এটি আসলে একটি বৌদ্ধস্তূপ, যেটি পরবর্তীকালে পাল বা সেনযুগে পঞ্চরত্ন মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছিল। মঙ্গলবার যেখান থেকে মুদ্রা উদ্ধার হয়েছে, সে জায়গা বল্লালঢিপির এক কিলোমিটারের মধ্যে। তবে এই এলাকার মাটির নীচে থেকে এই প্রথম কিছু উদ্ধার হল।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “ওখানে দু’ধরনের মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। কিছু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের। কিছু রানির আমলের। মুদ্রার রকম শুনে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, হয়তো কেউ ভাঁড়ে টাকা জমানোর মতো করে যখন যেমন পেয়েছেন মুদ্রাগুলি সঞ্চয় করেছিলেন। পড়ে ডাকাতের ভয়ে মাটির অল্প নীচে পুঁতে রেখেছিলেন। যাতে ডাকাতের চোখ এড়ানো যায় আবার নিজের প্রয়োজনে চট করে তুলে ফেলাও যায়। ১৮ বা ১৯ শতকে ওইসব অঞ্চলে ডাকাতের প্রবল উপদ্রব ছিল। আবার এমন হতে পারে বন্যার সময়ে ওই ভাঁড় কোনও ভাবে জলে পড়ে গিয়েছিল। তার ওপর পলির প্রলেপ পড়ে ঢেকে গিয়েছিল।”
নবদ্বীপের স্থানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মায়াপুর সংলগ্ন এলাকা ‘সোনামুগ ডালের’ জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন সোনামুগ না ফললেও ‘সোনডাঙা’ নামের গ্রাম সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। অতি উচ্চমানের, সুগন্ধি সেই ডালের দামও ছিল খুব চড়া। কোম্পানির অভিজাত সাহেবরা খেতেন এবং রফতানিও হত। সেই কারণেও এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুদ্রা পাওয়া অস্বাভাবিক নয় বলেই মনে করেন ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের গবেষকেরা।