২১ ডিসেম্বর নবদ্বীপ প্যাকের মাঠে দর্শকদের ভিড়।—নিজস্ব চিত্র।
আইএসএল শেষ। কিন্তু ফাইনালে কলকাতার মহম্মদ রফিকের গোল নিয়ে চর্চা এখনও চলছে। একই ছবি মফস্সলের ফুটবলের সংসারেও।
দুরন্ত গোলে মিলন সঙ্ঘকে মিউনিসিপ্যাল সকার কাপ (এমএসসি) জেতানোর পরে দম ফেলার ফুরসত নেই নন্দগোপালেরও। এ বছরটা না হয় কাটল, পরের বছরের জন্য ঘর গোছানো শুরু হয়ে দিয়েছে অনেক দল। নন্দগোপালের মোবাইলে তাই একের পর এক ক্লাব কর্তার ফোন আসছে। সকলেই চান একটিবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। তড়িঘড়ি দলে টানতে ভাল টাকাও অফার করছেন কেউ কেউ। যদিও নন্দ এখনও কাউকে কথা দেননি।
প্রতিযোগিতা শেষ হলেও, নবদ্বীপ আসলে এখনও ফুটবলেরই দখলে। প্রথম এমএসসি জয়ী মিলন সঙ্ঘের ক্লাব ব্যান্ডের আওয়াজ বা বিজিত ভ্রাতৃ সঙ্ঘের ক্লাব ভবনে গোটা পাড়ার রাত পিকনিক, বুঝিয়ে দিচ্ছে ফুটবল জ্বর এখনও কুয়াশার চাদরের মতো শহরের উপরে চেপে বসে রয়েছে।
তাই শুরু হয়ে গিয়েছে পরের বছরের প্রস্তুতিও। নন্দকে নিয়ে দড়ি টানাটানির মাঝে হাল ছাড়তে রাজি নয় তাঁর নিজের ক্লাব মিলন সঙ্ঘও। প্রতিযোগিতায় ফেয়ার প্লে ট্রফি জয়ী নব মিলন সঙ্ঘের রাইট উইঙ্গার নন্দের জার্সির নম্বর ৭। তাঁর ঠিকুজি কুলজির খোঁজে হন্যে হয়ে পড়েছেন মিলন সঙ্ঘের কর্তা শেখর সরকার। শেখরবাবু জানান, প্রথম নবদ্বীপ সকার কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দের পাশাপাশি একটা ভয়ও কাজ করছে। তিনি বলেন, “আমরা চাইব জয়ী টিম ধরে রাখতে। কিন্তু যে ভাবে প্রায় সব ক্লাব আমাদের এ বারের দলের খেলোয়াড়দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাতে জানি না এই টিম ধরে রাখতে পারব কি না।”
তিনি যে কিছু ভুল বলেননি তার প্রমাণও মিলেছে। ইতিমধ্যেই কয়েকটি ক্লাবের পক্ষ থেকে খেলার প্রস্তাব পৌঁছেছে মিলন সঙ্ঘের বাবলু সর্দার ও রঞ্জিত সর্দারের কাছেও। ৫০ হাজার টাকার দল করেও প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান পেয়ে মুষড়ে পড়েছেন সপ্তর্ষি ক্লাবের কর্মকর্তারা। তবে আক্ষেপ ভুলে মাঠে নেমে পড়েছেন তাঁরাও। ক্লাবের পক্ষ থেকে সত্যজিৎ গোস্বামী বলেন, “আগামী বারের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছি। বলতে পারেন অনেকটা এগিয়েও গিয়েছি। এখন থেকে শুরু না করলে হবে না।” তবে কোন কোন খেলোয়াড়কে দলে নিতে চান তা নিয়ে তিনি মুখ খুলতে নারাজ।
নবদ্বীপ আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থার প্রাক্তন সম্পাদক তথা নদিয়া ক্লাবের সম্পাদক গোবিন্দ বাগ বলেন, “আমরা কয়েক জন খেলোয়াড়কে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করেছি। আগামী মার্চে যাঁদের সঙ্গে ক্লাবের চুক্তি হবে। পরের বার তাঁরা নবদ্বীপ লিগ ও এমএসসি- দু’টি প্রতিযোগিতাতেই নদিয়া ক্লাবের হয়ে খেলবে।” তবে তাঁদের নাম প্রকাশ করতে চাননি গোবিন্দবাবুও।
বড়ালঘাট স্পোর্টিং ক্লাবের এক ক্রীড়া কর্তা লাল্টু ভুঁইয়া বলেন, “এ বার বেশ কয়েক জনের খেলা আমাদের চোখে পড়েছে। তাঁদের দু’তিন জনের সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে কথাও বলা হয়েছে।” “এই প্রতিযোগিতার প্রথম চারটি দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় আমাদের ক্লাবে আগে বৈদ্যনাথ বা অন্য ট্রফিতে খেলেছেন। এ বার আমরা বৈদ্যনাথ শিল্ড খেলিনি। ফলে তাঁরা অন্য ক্লাবে খেলেছেন। সামনের বার তাঁরা আমাদের হয়ে খেলতেই পারেন”, ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য আজাদ হিন্দ ক্লাবের কর্তা সুব্রত দত্তের।
তবে শুধু নন্দগোপাল বা বাবলু সর্দার নয়। প্রতিযোগিতার গোড়ার দিকে মাঠে নামা বিদেশি ড্যানিয়েল বিদেমি, অ্যানিলো, লেথানিলের মতো বিদেশিদের নামও ঘোরাফেরা করছে ক্লাব কর্তাদের মুখে। তবে বাসুদেব বা নন্দগোপালরা কেউই কলকাতা, হাওড়া, চুঁচুড়া, ভদ্রেশ্বর, কোন্নগর বা কাঁচরাপাড়া বাসিন্দা নন। ওরা সকলেই খোদ নবদ্বীপ শহর, গঙ্গার ওপারের স্বরূপগঞ্জ, রাউতারা, পার্শ্ববর্তী ধাত্রীগ্রাম বা সিমলনের বাসিন্দা। কেউ খেলার ফাঁকে মাঠে মজুর খাটেন, কারও সংসার চলে তাঁতের ভরসায়, কারও বাবা আবার প্যান্ডেলকর্মী। কিন্তু শেষ অবধি খেলায় নজর কাড়লেন তাঁরাই। এদের মধ্যে রয়েছেন এ বার সপ্তর্ষি ক্লাবে খেলা রাজু দেবনাথ (স্ট্রাইকার), সুমন সূত্রধর, শিবম পাল (রাইট উইঙ্গার), বাবলু সর্দার (স্ট্রাইকার), লোকনাথ সাহা (গোলকিপার)। রয়েছেন মিলন সঙ্ঘে খেলা নন্দগোপাল রায় (হাফ), বাসুদেব দেবনাথ (ডিফেন্ডার), রঞ্জিত সর্দার (হাফ), নব মিলন সঙ্ঘের অমিতকুমার সাহা (স্ট্রাইকার), টাউন ক্লাবের হয়ে খেলা সুদীপ সাহাও।
খেলোয়াড়রা- ১। অমিত কুমার সাহা। ২। বাবলু সর্দার ৩। বাসুদেব দেবনাথ ৪। লোকনাথ সাহা ৫। নন্দগোপাল রায় ৬। রাজু দেবনাথ।
শুধু এমএসসিতেই নয়, স্বরূপগঞ্জের সেবক সমিতির নির্মল ভৌমিকের হাতে তৈরি রাজু দেবনাথ নজর কেড়েছিলেন ভাইচুং ভুটিয়ারও। ২০১২ সালে সিকিম ইউনাইটেড ক্লাবে খেলার জন্য তিনি ডাক পেয়েছিলেন। নির্মলবাবুর আর এক ছাত্র নন্দগোপাল সিনিয়র ডিভিশনে বছর তিন-চার আগে সোনালি শিবিরের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন। ধাত্রীগ্রাম থেকে ৬ কিলোমিটার ভেতরে সিমলনের রঞ্জিত সর্দার প্রতিযোগিতায় যুগ্ম ভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। ২০০৫-০৬ সালে কলকাতার নর্থ এন্টালির হয়ে খেলেছিলেন তিনি। নবদ্বীপের অমিতকুমার সাহা স্থানীয় কর্মমন্দির ক্লাবের হয়ে উত্তরপাড়া নেতাজি বিগ্রেডে অনুশীলন করেছেন। ইস্টার্ন রেল, খিদিরপুর হয়ে কালীঘাট এমএস দলে খেলছেন। নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র গোলকিপার লোকনাথ সাহা চোট না পেলে সপ্তর্ষি ক্লাবকে হয়ত তৃতীয় স্থানে থাকতে হত না, এমন জল্পনা এখনও ঘোরাফেরা করছে। সব মিলিয়ে নবদ্বীপ মিউনিসিপ্যাল সকার এদের জন্যে নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে কিনা এখন সেটাই দেখার।
পাশাপাশি, বেশ কয়েক বছর ধরেই ধুঁকছে নবদ্বীপের ফুটবল লিগ। প্রথম দুই ডিভিশন মিলিয়ে এবারের তেরো দলের ফুটবল লিগের কোনও খেলায় মেরে কেটে পঞ্চাশ জন দর্শকও হয়নি। অথচ লিগে নথিভুক্ত ক্লাবের সংখ্যা চল্লিশেরও উপর। এমএসসির প্রভাবে তাই ফুটবল লিগেও আবার উৎসাহের জোয়ার বইবে এই আশায় বুক বাঁধছেন নবদ্বীপের ফুটবল প্রেমীরা। একই আশায় বুক বাঁধছে এমএসসি-র নতুন মুখ নন্দগোপালরাও।
ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিয়ে নন্দ জানিয়ে দেন, “সুযোগ পেলে আমিও আটলেটিকোর ‘রফিক’ হতে পারি।” পারেন কি না সেটা সময়ই বলবে।