মৃৎশিল্পীরা মর্যাদা পাবেন কবে?

বছর কুড়ি আগে শিল্পী সুবীর পালকে বিয়ে করার পর পুতুলপট্টিকে ভিতর থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কুমারটুলির বিখ্যাত শিল্পী সুনীল পাল আ‌‌মার বাবা। তাই এই শিল্পকর্ম সম্পর্কে আমার আকর্ষণ ছোটোবেলা থেকেই। তাই যখন শ্বশুর বীরেন পালকে একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় তখন আমার মনে এক অনন্য অনুভূতির তৈরি হয়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:১৬
Share:

কলকাতার বড়িষার একটি পুজো মণ্ডপ সাজানো হবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নৃত্যকলা ও বাদ্যযন্ত্রের মাটির পুতুল দিয়ে। তারই কাজ চলছে কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে। সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

বছর কুড়ি আগে শিল্পী সুবীর পালকে বিয়ে করার পর পুতুলপট্টিকে ভিতর থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কুমারটুলির বিখ্যাত শিল্পী সুনীল পাল আ‌‌মার বাবা। তাই এই শিল্পকর্ম সম্পর্কে আমার আকর্ষণ ছোটোবেলা থেকেই। তাই যখন শ্বশুর বীরেন পালকে একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় তখন আমার মনে এক অনন্য অনুভূতির তৈরি হয়। সংসারে অভাব ছিল। কিন্তু তারপরেও বীরেন পালের মতো এতবড় শিল্পীকে বাবা বলে ডাকার সৌভাগ্য হয়েছিল বলে আমি গর্বিত।

Advertisement

বাবা মারা গিয়েছেন। কিন্তু এখনও তাঁকে ঘিরে আমার নানা স্মৃতি পাক খেয়ে বেড়ায়। কেবলই মনে হয় কোথায় গেল কার্তিক পাল, মুক্তি পাল, শম্ভু পাল, গণেশ পাল, সুধীর পাল, কানাই পালদের মতো কিংবদন্তী শিল্পীরা। যাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব ঘরানা খ্যাতির চরম সীমায় নিয়ে গিয়েছিল এই ঘূর্ণির পুতুলপট্টিকে।

আমরা স্বামী খুব অল্প বয়সেই রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছে। একই পুরস্কার পেয়েছেন আমার শ্বশুরও। কিন্তু শুধু মাত্র শিল্পকে ভালবেসে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কী ভয়ঙ্কর দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে তাঁদের যেতে হয়েছে তা ভাবলে আজও আমি অবাক হয়ে যাই। শিল্পের কতটা টান থাকলে তাঁরা লোভনীয় প্রস্তাব অনায়াসে ফিরিয়ে দিতে পারেন। শুধু মাত্র কাজের ক্ষতি হবে বলে। কিন্তু তার জন্য কোনও দিন আফশোস করতে দেখিনি।

Advertisement

সকলে তাঁকে বিরাট শিল্পী বলে জানেন। আর আমরা যাঁরা দিনের পর দিন তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি তারা জানি তিনি শুধু বড় শিল্পীই ছিলেন না, বিরাট মনের মানুষও ছিলেন। গোটা পুতুলপট্টিকে তিনি আগলে রাখতেন। সকলকেই অকাতরে দান করতেন। বলতেন, ‘‘আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যেই তিনি বেঁচে থাকবেন। অর্থ-যশ নয়। তিনি চাইতেন বেঁচে থাক শিল্পটা।’’

আর আজ চারপাশে তাকালে বড় কষ্ট হয়। নিজের রক্তে এই শিল্প থাকার কারণেই হয় তো কেবলই মনে হয় আমি এসে যে সব কাজ দেখে ছিলাম সে সব কাজ কই? এখন শিল্পীদের সেই ভয়ঙ্কর অভাব আর নেই। অনেকেই আজ বাণিজ্যিক ভাবে সফল। অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল। কিন্তু আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যে সব শিল্প সৃষ্টি হতে দেখে ছিলাম তা যেন খুঁজে পাই না। আজ বীরেন পালের তিন প্রজন্মের ফাইবার গ্লাসের অবয়ব মুম্বই এয়ারপোর্টে ঠাঁই পেয়েছে। এটা হয় তো আমাদের কাছে গর্বের বিষয় কিন্তু আজ যেন পুতুলের ভিতরে সেই প্রাণের স্পন্দন পাই না।

অনেকেই অবশ্য এর ভিতরেও ভাল ভাল কাজ করছেন। কিন্তু কোথায় শিল্পীর সেই ত্যাগ, সংগ্রাম, আবেগ? তাই আজ সুখের দিনে সেইসব মানুষগুলোর কথা খুব মনে পড়ে।

স্নেহা পাল, ঘূর্ণি।

চাই নিত্য নতুন সৃষ্টি

আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার শহর—ঘূর্ণি সম্পর্কে ‘বিপদে আজও দুয়ার খোলা পুতুলপট্টির’ প্রতিবেদনটি খুবই সময়োপযোগী। প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দু’টি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। এক, কৃষ্ণনগরে মৃৎশিল্পকে বাঁচানো। দুই, এই শিল্প থেকে কর্মসংস্থান ও উপার্জন বাড়ানো। দুভার্গ্যের বিষয় বিশ্বে শিল্প নন্দিত হলেও এই শিল্পকে ঘিরে কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ করা হয়নি। এক সময় রুজি রোজগারের তাদিগে লোকে এই শিল্পকে আঁকড়ে ধরলেও এখন কেউ সে ভাবে উৎসাহিত নন। সেই সঙ্গে ঘূর্ণির সঙ্গে আজও কৃষ্ণনগর শহরের মানসিক দূরত্ব রয়ে গিয়েছে। ঘূর্ণির শিল্পীরা তাঁদের প্রাপ্য মযার্দাটুকু থেকে আজও বঞ্চিত।

সম্প্রতি শহরের এক প্রান্তে একটি শিল্পহাট চালু হয়েছে। কিন্তু তাতে এই শিল্প কতটা পুনরুজ্জীবিত হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

বিদেশের রাষ্ট্রনায়কেরা কৃষ্ণনগরের পুতুলের সুখ্যাতি করলেও শিল্পীরা সেই আড়ালেই থেকে গেলেন। কৃষ্ণনগরে পা রাখলে কেউ কী খোঁজ নেন সুবীর পাল, মৃগাঙ্ক পাল, বাবলু পাল, শিশির পালেদের। আজীবন তাঁরা মেঘে ঢাকা তারা হয়ে রইলেন।

তবে কিছু পদক্ষেপ করলে শিল্পে পুনরুজ্জীবন ঘটলে বলে আমার আশা। শিল্পী গৌতম পাল তাঁর কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্যের কথা’ প্রবন্ধে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। ১) নতুন প্রজন্ম যদি শুধু কারিগরি দক্ষতা নিয়ে পড়ে থাকেন তা হলে হবে না। প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে নিত্যনতুন সৃষ্টির দিকে নজর দিতে হবে। তা হলে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হবে।

২) নেশা ও পেশা থেকে নতুন কিছু করার ভাবনা শিল্পীদের মধ্যে এসেছে। তাঁদের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে।

স্বদেশ রায়, কৃষ্ণনগর।

(চিঠিগুলি পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement