চলছে নজরদারি। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
খুনসুটি করতে করতে খুদে পড়ুয়ারা নিজেদের মধ্যে কখনও মারপিটেও জড়িয়ে পড়ে। সহপাঠীর খাতা-পেনসিল খোয়া গেলে শুরু হয় হইচই। পাাঠদানের সময় অমনোযোগী পড়ুয়াকে চিহ্নিত করাও খুব সহজ কাজ নয়। এমনকি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেদের ভূমিকা কতটা ও কেমন ভাবে পালন করেন তার মূল্যায়নও বেশ কষ্টকর বিষয়।
এমন নানা সমস্যার সমাধানের পথ নিজেরাই বাতলেছেন মুর্শিদাবাদের মরিচাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকশিক্ষিকারা। জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভা এলাকার ৪ নম্বর বেগমগঞ্জ ওয়ার্ড এলাকার ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ টি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেদের টাকায় ইতিমধ্যে ৫ টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসিয়েছেন। আজ, বৃহস্পতিবার সেই ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার উদ্বোধন করবেন মুর্শিদাবাদ জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি দেবাশিস বৈশ্য ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জেলা পরিদর্শক রাখী মণ্ডল। এ দিনের ওই অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়ের বিশুদ্ধ পানীয় জলপ্রকল্পের উদ্বোধন ও বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে মিড ডে মিলের রান্নার সময় পরার জন্য অ্যাপ্রন।
ওই বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক নাড়ুগোপাল চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অপ্রীতিকর কোনও ঘটনার দায় কোনও পড়ুয়া অস্বীকার করে মিথ্যা বললে তাকে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় ঘটনার রিপ্লে দেখানো হবে। তখন সে নিজের ভুল বুঝতে পারবে। তার ফলে শিশুমনে প্রথম থেকেই মিথ্যা বলার প্রবণতা কমবে ও সঠিক ভাবে সে গড়ে উঠবে। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকশিক্ষিকার অনুপস্থিতির সময় স্বতঃস্ফূর্ত আচার আচরনের মধ্য দিয়ে শিশুর স্বাভাবিক স্ফূরণের পরিচয় মিলবে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ছবি থেকে। সেই কারণেই এমন উদ্যোগ।”
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সুন্দরবনের বাসন্তি ব্লকের নারায়ণতলা রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দিরে চালু হয়েছে সিসিটিভি, ভিডিও রেকর্ডিং সিস্টেম এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বায়োমেট্রিক হাজিরা পদ্ধতি। কোনওরকম সরকারি সাহায্য ছাড়াই ছাত্রছাত্রীদের শৃঙ্খলরক্ষা, পঠনপাঠন ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপস্থিতি নজরে রাখতে এমন ব্যবস্থা চালু করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। মাস কয়েক আগে নদিয়ার নাকাশিপাড়া পাটপুকুর হাই স্কুলেও সিসিটিভি বসিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। পরে তা মিটেও যায়।
তবে মরিচাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এমন উদ্যোগকে অবশ্য সকলেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে ওই বিদ্যালয়ের দীর্ঘ ইতিহাস। প্রধানশিক্ষক নাড়ুগোপাল চট্টোপাধ্যায়কে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় শিক্ষক’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১২ সালে তাঁকে রাজ্য শিক্ষা দফতর থেকে ‘শিক্ষারত্ন’ দেওয়া হয়। ২০১২ সালে এবং ২০১৪ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তকমাও পেয়েছে ওই বিদ্যালয়টি। ২০১২ সালে জেলার অন্যতম ‘নির্মল বিদ্যালয়’-এর স্বীকৃতি পায়।
স্থানীয় হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জিয়াগঞ্জের সমীর ঘোষ বলেন, “লঙ্কা অর্থাৎ মরিচ চাষিদের বসবাস ছিল ওই এলাকায়। দুঃস্থ মরিচ চাষিদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য ১৯৭৩ সালে নাড়ুগোপাল চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয় মরিচ চাষিদেরই দানের টাকায়। তারপর ১৯৮০ সালে সরকারি অনুমোদন মেলে। নাম হয় মরিচ প্রাথমিক বিদ্যালয়। নাড়ুগোপালবাবু ও তাঁর সহশিক্ষকদের উদ্যোগে সে দিনের কুঁড়েঘরের বিদ্যালয় আজকের ত্রিতল পাকাভবনে উন্নীত হয়েছে।”
স্কুলে রয়েছে ছাত্রছাত্রীদের জন্য পৃথক শৌচালয়, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা। বাদ যায়নি অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাও। সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি, মণীষীদের প্রতিকৃতি, দেশ-রাজ্য-জেলার মানচিত্র, রাষ্ট্রপতি-প্রধানন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের তালিকা। ঋতুচক্র ও আবহাওয়া পরিবর্তনের মানচিত্রের পাশাপাশি রয়েছে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত পোস্টারও। স্থানীয় বাসিন্দা হুমায়ুন কবীর বলেন, “নাড়ুগোপালবাবুর উদ্যোগে সরকারি ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের মান ও শিক্ষকশিক্ষিকাদের আচরণে আকৃষ্ট হয়ে ৫-৬ কিলোমিটার দূরের কালিকূপ, গুজোষ্ঠিরামপুর ও সাদেক সরাই বাঁধন- সহ দূরদুরান্তের ৫-৭টি গ্রামের দিন-আনা দিন-খাওয়া পরিবারের সন্তানদের ভিড়ে ঠাসা ওই বিদ্যালয়।
প্রধানশিক্ষকও বলেন, “৩৫৮ জন ছাত্রছাত্রীর অধিকাংশই দূরদূরান্তের বিপিএলের তফসিলি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পযর্ন্ত মোট ৫ টি শ্রেণির ওই বিদ্যালয়ে খুদে পড়ুয়াদের নিয়ে রয়েছে নকল সংসদ। খুদের নিয়ে নিয়মিত ক্যুইজ, বিতর্ক ও তাৎক্ষণিক বক্তৃতা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সহ-শিক্ষকদের অবদান অতুলনীয়।”
জিয়াগঞ্জ চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক তাজরুল ইসলাম বলেন, “সব কৃতিত্বই এই বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক-সহ মোট আট জন শিক্ষক-শিক্ষিকার। মরিচা প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে মডেল হিসাবে তুলে ধরে জেলার অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনুপ্রাণিত করা হবে।”