গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতাল।
এ রাজ্যে স্বপ্ননগরী হিসেবে তৈরি হয়েছিল কল্যাণী। সবুজে সাজানো টাউনশিপ, বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য কল্যাণী পছন্দের শহর ছিল বহু মানুষের কাছে। তাই বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে সাড়া মিলেছিল গোড়া থেকে। শান্তিপ্রিয়, স্বচ্ছল মানুষের বসবাসের জায়গা তৈরি হয়েছিল। ছবির মতো সুন্দর বাগান ঘেরা বাড়ি এ শহরের প্রতিটি রাস্তায়। রাস্তার মধ্যেও সবুজের সমারোহ। বাতিস্তম্ভে টবে বাহারি ফুল গাছ। সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
এ শহরের মুক্ত পরিবেশ স্বাস্থ্য আর শিক্ষার পীঠস্থান হতে তাই বেশি সময় নেয়নি। ১৯৫৪ সালে কল্যাণী বি ব্লকে দু’টি বাড়িতে চালু হয় ১৪ শয্যার স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ১৯৬০ সালে জওহরলাল নেহেরু মেমোরিয়াল হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। ৫০০ শয্যার এই রেফারাল হাসপাতাল দক্ষিণবঙ্গের রোগীদের কাছে প্রাণকেন্দ্র। ১৯৬৮-র ২৪ মার্চ রাজ্যের একমাত্র হৃদরোগের চিকিত্সা কেন্দ্র গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতাল উদ্বোধন করেন রাজ্যপাল ধরমবীরা। ওই বছরেই ২০ ডিসেম্বর কল্যাণী শিল্পাঞ্চলের ৬০০ কারখানার শ্রমিক কর্মচারীর স্বার্থে ২৫০ শয্যার ইএসআই হাসপাতাল চালু হয়। এক সময়ে এই কল্যাণীতেই তৈরি হয়েছিল যক্ষ্মা রোগের চিকিত্সার জন্য নেতাজি সুভাষ স্যানেটরিয়াম। রাজ্যপাল নুরুল হাসানের নামে একটি স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি হওয়ার কথা ছিল এখানে। রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা তার ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছিলেন। তবে এখন নানা আগাছার মধ্যে সেই ফলকটিই থেকে গিয়েছে।
৬০ বছর পার করে এ শহর রাজ্যে অন্যতম স্বাস্থ্যনগরী। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, হৃদরোগের চিকিত্সার জন্য সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, টিবি স্যানেটরিয়াম, আয়ুর্বেদ হাসপাতাল, অসংখ্য নার্সিংহোম নিয়ে কল্যাণী এই রাজ্যের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিশারী। এই শহর এইমস-এর আশাও দেখে। শহর কল্যাণীর জন্মের পর দু’জন ডাক্তার এখানে চিকিত্সা করতেন। এখানে এখন পাঁচশো’রও বেশি চিকিত্সকের বাস।
ইএসআই হাসপাতাল।
এত পরিকাঠামো সত্ত্বেও শহরের স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ঠিক কেমন?
সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতায়, হাসপাতালগুলি দালালচক্রের আখড়া। ইএসআই হাসপাতালে কখনও রোগী খারাপ খাবার দেওয়ায় অনশন করেন। আবার কখনও মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়ারা পঠনপাঠনের পরিকাঠামো নেই বলে ধর্নায় বসেন। সামগ্রিক ভাবে শহরের সব হাসপাতালেই পরিষেবার মান খারাপ হয়েছে বলে অভিযোগ। গজ-ব্যান্ডেজ, সেলাইয়ের সুতো পর্যন্ত রোগীর পরিবারকে কিনে দিতে হয় বেশির ভাগ সময়ে। অধিকাংশ পরীক্ষা করাতে হয় বাইরে থেকে। ওষুধের দোকানগুলিও দালাল চক্রের কাছে বাঁধা বলেও অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। যে কারণে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ছাড়া অন্য ওষুধ মেলে না। ন্যায্য মূল্যের ওষুধ দোকান থাকলেও সেখানেও বহু ওষুধ মেলেই না। আবার চিকিত্সকদের অনেকে সরাসরি ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ নিতে বারণ করেন বলে রোগীদের পরিবারের অভিযোগ। হাসপাতালে রোগীকে ঢোকানোর আগেই রোগীর আত্মীয়দের ‘নেই’-এর ফিরিস্তি শুনিয়ে কোন নার্সিংহোমে গেলে ভাল পরিষেবা মিলবে, তার পরামর্শ দেওয়া হয়! হাতে গোনা কয়েক জন চিকিত্সক ছাড়া সকলেই নিজেদের চেম্বার, ক্লিনিক আর বিভিন্ন নার্সিংহোমে বেশি সময় দেন বলে স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা। হাসপাতালের রোগীই সেখানে গেলে পরিচর্যা বেশি পান এমন অভিজ্ঞতা বহু জনের। একাকী থাকা প্রবীণরা স্বাস্থ্যনগরীতে থেকেও বহু ক্ষেত্রে চিকিত্সার সুযোগ পান না। কারণ অধিকাংশ চিকিত্সকই বোর্ড টাঙিয়ে রেখেছেন বা যোগাযোগ করলে জানিয়ে দেন, বাড়িতে গিয়ে তাঁরা চিকিত্সা করেন না!
কল্যাণীর টিবি হাসপাতাল।
সমস্যা আরও। কল্যাণী জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিউরোলজি, ইউরোলজি, প্লাস্টিক সার্জারির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে চিকিত্সক নেই। অথোর্পেডিক বিভাগ সপ্তাহে তিন দিন খোলা। ইএসআই হাসপাতালের ছবিটাও একই রকম। এই হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ২৫০টি। প্রায় সব বিভাগ আছে। কিন্তু ডেলিভারি রুম নেই। সে ক্ষেত্রে প্রসূতিকে কল্যাণী জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। টিবি হাসপাতাল ধুঁকছে। ডট চিকিসা আসার পরে রোগী কমে গিয়েছে। হাসপাতালের মূল বাড়ি ছাড়া বাকি বাড়িগুলিতে ঝোপ গজিয়েছে। ৬ জন মাত্র চিকিত্সক। উল্টো দিকেই গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতাল। দৈন্য দশা সেখানেও স্পষ্ট। রাজ্যে একমাত্র হৃদরোগের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে হৃদরোগের সার্জেন সাকুল্যে দু’জন। অধিকাংশ যন্ত্রই মান্ধাতা আমলের। অ্যাঞ্জিওগ্রাফি হয় না। পেসমেকার বসানো বা করোনারি বাইপাস সার্জারি করার যন্ত্র খারাপ দীর্ঘদিন ধরে। এই প্রসঙ্গে রাজ্য স্বাস্থ্য সেলের আহ্বায়ক কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল -এর এক প্রবীণ কর্মী মনোরঞ্জন ভদ্র বলেন, “সমস্যা অনেক। তবে আসল সমস্যা হল মানসিকতার। পরিকাঠামো থাকলেও রোগীরা পরিষেবা পাবেন না, যদি না স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিত্সকদের মানসিকতার পরির্বতন হয়।”
(চলবে)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর কল্যাণী’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।