শিশু পাচার রহস্যে নয়া মোড়, ঠাকুরপুকুরে উদ্ধার ঝুলন্ত দেহ

শিশু পাচার-কাণ্ডে এ বার নতুন রহস্যের ছায়া। মূলে, এক যুবকের অপমৃত্যু। যে কিনা সম্পর্কে এক অভিযুক্তের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:৩১
Share:

তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়

শিশু পাচার-কাণ্ডে এ বার নতুন রহস্যের ছায়া। মূলে, এক যুবকের অপমৃত্যু। যে কিনা সম্পর্কে এক অভিযুক্তের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

Advertisement

শিশু পাচারের তদন্তে এই ক’দিনে দু’জায়গায় মোট ১৩টি সদ্যোজাতকে উদ্ধার করা হয়েছে। মাটি খুঁড়ে মিলেছে দু’টি বাচ্চার হাড়গোড়। পাচার-চক্রে জড়িত সন্দেহে সিআইডি’র হাতে ধরা পড়েছে একের পর এক মহিলা-পুরুষ। শনিবার গভীর রাতে ধরা হয় এক হাতুড়ে চিকিৎসক তপন বিশ্বাস ও এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী বাসন্তী চক্রবর্তীকে। আর তার কয়েক ঘণ্টা পরে ঠাকুরপুকুরে গলায় দড়ির ফাঁস লাগানো অবস্থায় মিলেছে বাসন্তীর ভাইপো তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের (২৫) দেহ। শিশু পাচার তদন্তের প্রেক্ষাপটে একে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছে সিআইডি’র একাংশ।

ঘটনা হল, শনিবার রাতে ঠাকুরপুকুরে বাসন্তীকে ধরেও তার মোবাইল ফোনের হদিস পাননি গোয়েন্দারা। বাসন্তী তাঁদের জানিয়েছিল, ফোনটি রয়েছে তার ভাইপো তন্ময়ের কাছে। রাতেই তন্ময়কে ঠাকুরপুকুর থানায় ডাকা হয়। তদন্তকারীদের দাবি— তন্ময় জানিয়েছিলেন, পিসি তাঁকে কোনও ফোন দেয়নি। তন্ময়ের ফোনটি পুলিশ জমা রাখে। তন্ময় বাড়ি ফিরে যান।

Advertisement

এ দিন ভোরে সেই যুবকেরই ঝুলন্ত দেহ উদ্ধারের পরে তদন্তকারীদের প্রাথমিক ধারণা, তন্ময় অনেক গোপন তথ্য জানতেন। যা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি হয়তো আত্মহত্যা করেছেন। তন্ময়ের মোবাইলটি পরীক্ষা করা হচ্ছে। মৃতের দিদি শর্মিষ্ঠা এ দিন বলেন, ‘‘পিসির জন্য থানায় যেতে হল, এটা ভাই মানতে পারছিল না। রাতে থানা থেকে ফেরার পরে ওকে খুব বিভ্রান্ত লাগছিল।’’ তাঁর ভাই পাচার চক্রে কোনও ভাবে জড়িত নয় বলেও দাবি করেছেন শর্মিষ্ঠা। পুলিশ জানতে পেরেছে, তন্ময়ের বাবা বাসন্তীকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে সাহায্য করতেন।

শুক্রবার ভোরে দক্ষিণ শহরতলির ঠাকুরপুকুরের ‘পূর্বাশা’ হোমে দশটি শিশুকন্যা উদ্ধার হওয়া ইস্তক সিআইডি বাসন্তীকে খুঁজছিল। বছর বাহান্নর বিধবা মহিলাটি ঠাকুরপুকুরে ‘মিলেনিয়াম ওল্ড এজ হোম অ্যান্ড রিহ্যাব সেন্টার’ নামক বৃদ্ধাশ্রমের এক তলায় থাকত।
তার ছেলে থাকে দোতলায়। কোনও আবাসিক ওখানে কোনও দিনই ছিলেন না। উল্লেখ্য, বৃদ্ধাশ্রমটির কর্ণধার হলেন সেই বিমল অধিকারী, ‘পূর্বাশা’ হোমে পাচারের জন্য শিশু রাখার অভিযোগে শুক্রবার যাকে ধরা হয়েছে। সিআইডি-সূত্রের খবর: প্রায় দু’দিন বেপাত্তা থাকার পরে বাসন্তী শনিবার গভীর রাতে ভাইপোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তখনই জালে পড়ে।

বাসন্তীকে ধরতে ততটা বেগ না পেলেও সিআইডি-কে কিছুটা ঘোল খাইয়েছে বনগাঁর হাতুড়ে তপনকুমার বিশ্বাস। যে কিনা পাচার-চক্রের অন্যতম পাণ্ডা বলে গোয়েন্দাদের দাবি। গত ২১ নভেম্বর বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোমে শিশু উদ্ধারের পর থেকে বছর বিয়াল্লিশের তপনকে সিআইডি খুঁজে বেড়াচ্ছিল। গাইঘাটার বড়া গ্রামের বাড়িতে গিয়েও তার দেখা মেলেনি। শেষে শনিবার মাঝ রাতে বর্ধমানের মেমারির পাল্লা রোডে এক আত্মীয়ের বাড়িতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সিআইডি সূত্রের খবর, গত ২১ নভেম্বর সোহান নার্সিংহোমের কথা জানাজানি হতেই তপন গা ঢাকা দেয়। এই ক’দিন সে নদিয়া, বর্ধমানে নানা নার্সিংহোম-কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে কোথাও দু’দিনের বেশি কাটায়নি। এর মধ্যে সে মোবাইলের প্রায় ১৪টি সিম বদলেছে। শনিবার সকালে গোয়েন্দারা খবর পান, তপন পাল্লা রোডে আত্মীয়ের বাড়ি এসেছে। ‘সোর্স’ মারফত নজরদারি শুরু হয়। সিআইডি’র দাবি, তপনের আত্মীয়েরা তাকে রাখতে চাননি। সে কাকুতি-মিনতি করে এক রাত থাকার ব্যবস্থা করে।

পুরো রাত অবশ্য কাটাতে হয়নি। রাত দু’টো নাগাদ বাড়ির পিছনে একটা মাটির ঘরের ভিতরে গোয়েন্দারা তার হদিস পান। ‘‘তপন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল।’’— বলেন এক সিআইডি অফিসার। তাঁর কথায়, ‘‘গোড়ায় আমরা একটু ধন্দে পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, ছবির সঙ্গে ওকে মেলানো যাচ্ছিল না। গোঁফ কেটে ফেলেছে। চুলের কায়দাও পাল্টে দিয়েছে। শুধু বলে যাচ্ছিল, ও সেই তপন নয়।’’ শেষমেশ আশ্রয়দাতা পরিজনেরাই এসে তার জারিজুরি ফাঁস করে দিয়েছেন বলে গোয়েন্দাদের দাবি।

তন্ময়ের মা পূর্ণিমা দেবী। রবিবার ঠাকুরপুকুরে। —নিজস্ব চিত্র

এ দিকে গাইঘাটায় তপনের পড়শিরা জানিয়েছেন, বছর পনেরো আগেও সে এলাকায় হাতুড়ে ডাক্তার হিসেবে মামুলি জ্বর-সর্দি-কাশির চিকিৎসা করত। বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোমে যুক্ত হওয়ার পরে তার ঠাটবাট বিস্তর বেড়ে যায়। বছর কয়েক আগে বাড়িতে দোতলা তোলে। প্রসূতিরা যাতে তার নার্সিংহোমে যায়, সে জন্য তপন গ্রামে মাইক নিয়ে রীতিমতো প্রচার চালাত।

এই অবস্থায় সিআইডি’র দৃঢ় সন্দেহ, তপন বাংলাদেশেও বাচ্চা চালান করেছে। ‘‘ফেরার অবস্থাতেও তপন একাধিক বাংলাদেশির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে। কাদের কাদের সঙ্গে কথাবার্তা চলেছে তা জানার চেষ্টা চলছে।’’— বলছেন এক তদন্তকারী। ওঁদের অনুমান, তপন নদিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালানোর মতলবে ছিল।

বাসন্তী ও তপনকে এ দিন বসিরহাট এসিজেএম কোর্টে তোলা হলে বিচারক দু’জনকেই বারো দিন সিআইডি হেফাজতে রাখতে বলেছেন। আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে দু’জনেই দাবি করেছে, তারা নির্দোষ। ‘‘নার্সিংহোম ডাকলে গিয়ে প্রসব করাতাম। পরে ওখানে কী হতো, জানি না।’’— মন্তব্য তপনের। বাসন্তীর দাবি, ‘‘আমি সামান্য কর্মচারী। যা করতে বলা হতো, করতাম। এর বেশি কিছু জানি না।’’

সিআইডি’র এক শীর্ষকর্তা এ দিন জানিয়েছেন, শিশু পাচার-তদন্তে এই ছ’দিনে মোট ১৮ জন গ্রেফতার হয়েছে। তাদের জেরা করে জট অনেকটা খুলেছে, নিত্য-নতুন তথ্যও মিলছে। শিগগিরই আরও কুশীলবের সন্ধান মিলবে বলে সিআইডি’র আশা। গোয়েন্দা-সূত্রের ইঙ্গিত, ধৃত বিমল অধিকারীর ছেলে এক সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। তার ব্যাপারেও খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। তথ্য সহায়তা: সৌমেন দত্ত, নির্মল বসু ও সীমান্ত মৈত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন