আইনের ফাঁকে অবাধ শিশুমেধ, বাঁচবে কি ইলিশ

জরিমানা দিলে সাত খুন মাফ— আইনের এই ফাঁককে হাতিয়ার করে গোটা রাজ্যে দেদার বিকোচ্ছে ‘শিশু’ ইলিশ। এক একটির ওজন বড় জোর ৫০ থেকে দেড়শো গ্রাম। দাম, কিলো প্রতি ৯০ থেকে ১২০ টাকা।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৬ ০৪:২১
Share:

ইলিশছানা। এমনই মাছ আসছে আড়তে। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়।

জরিমানা দিলে সাত খুন মাফ— আইনের এই ফাঁককে হাতিয়ার করে গোটা রাজ্যে দেদার বিকোচ্ছে ‘শিশু’ ইলিশ। এক একটির ওজন বড় জোর ৫০ থেকে দেড়শো গ্রাম। দাম, কিলো প্রতি ৯০ থেকে ১২০ টাকা।

Advertisement

সরকারি বিধি হল, ৩৫০ গ্রামের নীচে ইলিশ মাছ ধরা ও বিক্রি নিষিদ্ধ। আরও নিয়ম— ছোট মাছ যদি ধরা পড়ে তা হলে তা বিক্রি করলে যত দাম হবে, তার অর্ধেক টাকা ট্রেজারিতে জরিমানা দিতে হবে। তা হলেই ছাড়। মৎস্যজীবীরাই জানাচ্ছেন, অর্ধেক ‘রাজস্ব’ দিয়ে বাকি অর্ধেক মুনাফার লোভে অন্য মাছের সঙ্গে ছোট ইলিশও ধরা হচ্ছে। জরিমানা দেওয়ার পরে সেই ছোট ইলিশ কাগজে-কলমে ‘বৈধ’ হয়ে চলে যাচ্ছে বাজারে। আইনত তাদের কিছু করার থাকছে না বলেও জানাচ্ছে পুলিশের।

যে ভাবে কলকাতা পুরসভাকে জরিমানা (রিটেনশন চার্জ) দিয়ে বেআইনি নির্মাণকে এখন বৈধ করে নেওয়া যায়, আইনের সেই ফাঁক গলে বাজারে বিকোচ্ছে ইলিশের ছানা-পোনারা। ‘ওয়েস্টবেঙ্গল ইউনাইটেড ফিশারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের’ যুগ্ম সম্পাদক বিজন মাইতি বলেন, ‘‘ধরা যাক ১০০ গ্রাম ওজনের একটি ছোট ইলিশ বাজারে বিক্রি করে দাম মিলবে ১০০ টাকা। সুতরাং ৫০ টাকা জরিমানা দিলেই সেই ইলিশ বিক্রির সাত-খুন মাপ। আইনেই রয়েছে এ-টা।’’ তাঁরই প্রশ্ন— তা হলে ছোট ইলিশ ধরা বন্ধ হবে কী ভাবে? তাই এই আইন বদলের আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা। নিয়মের এই ফাঁকে প্রশাসনও যে অসহায়, তার ইঙ্গিত মিলেছে মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহয়ের কথাতেও। তিনি বলেন, ‘‘আইনের সুযোগ নিয়ে বাজারে বেশি করে শিশু ইলিশ আসছে। এই আইন সংশোধন করতে হবে।’’

Advertisement

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সম্প্রতি ছোট ইলিশ ধরা নিয়ে মৎস্যজীবীদের সতর্ক করেছেন। কিন্তু সব কিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গোটা রাজ্যে বিক্রি হচ্ছে ছানা ইলিশ। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সদর বারাসত বাজারের কথাই ধরা যাক। জেলা মৎস্য দফতরের অফিস থেকে যখন ঘোষণা চলছে, ‘ছোট ইলিশ বিক্রি করবেন না, কিনবেন না।’ তখন অদূরে চাঁপাডালি মোড়ে মাছের আড়তে বরফবন্দি হয়ে ট্রাকে-ট্রাকে ঢুকছে ছোট ইলিশ। আড়দারেরা জানালেন, সেখানে প্রতিদিন অন্তত ৯০ কুইন্টাল ছোট ইলিশ আসছে। দেড় থেকে ২ মাস বয়সের সেই ইলিশের ওজন ৫০ থেকে দেড়শো গ্রাম। গোবিন্দলাল দাস নামে এক আড়তদারের কথায়, ‘‘এই মাছের স্বাদও তেমন নেই, নেই দামও। অথচ দু’মাস অপেক্ষা করলে এই মাছের বয়স চার মাস হতো, ওজন ৫০০ গ্রাম ছাড়িয়ে যেত। তখন স্বাদ, দাম দুই বাড়তো। অথচ মাসখানেক ধরে প্রতিদিনই ছোট ইলিশের আমদানি বেড়ে চলেছে।’’

কিন্তু কোথা থেকে, কী ভাবে ধরা হচ্ছে এত ইলিশ ছানা? আড়তদারদের কথায়, কিছু শিশু ইলিশ আসছে দিঘা, শঙ্করপুর থেকে, বেশির ভাগ আসছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক পুলিশ কর্তা জানালেন, ছোট ইলিশের পোষাকি নাম ‘পিল।’ এই জেলার নামখানা, বকখালি, কাকদ্বীপ, সাগর, পাথরপ্রতিমা, রায়দিঘি এবং কুলতলি থেকে ইলিশের পোনা ধরা হচ্ছে। ওই এলাকায় মোট ২ হাজার ট্রলার সাগরে পাড়ি দেয়। তার মধ্যে ৯০০টি ট্রলারই ছোট ইলিশ ধরে। শুধু
জুলাই মাসেই এক একটি ট্রলার ৮০০ কেজি করে ছোট ইলিশ ধরেছে। বিজনবাবুর কথায়, ‘‘হিসেবে দেখা গিয়েছে, ৯০০টি ট্রলার থেকে জুলাই মাসেই শুধু ৭২০০ কুইন্টাল ছোট ইলিশ ধরা হয়েছে। এ ভাবে মাছ ধরা চলবে জুলাই থেকে টানা তিন মাস।’’ সমুদ্রে মাছ ধরতে যান এমন মৎস্যজীবীরাই জানালেন, ৯০ সেন্টিমিটার ফাঁসের (গ্রিল নেট) জাল দিয়েই মাছ ধরার নিয়ম। কিছু মৎস্যজীবী ছোট মাছ ধরার বিশেষ জাল (ট্রল নেট) ব্যবহার করছেন। তাতেই ছোট ইলিশ ছাড়াও ধরা পড়ছে ১ টাকার ‘কয়েন’ এর আকারে পমফ্রেট মাছ, কুঁচো ভোলা মাছও। এমন জালের কথা শুনেছেন মৎস্যমন্ত্রীও। তিনি বলেন, ‘‘বিশেষ জালে শিশু ইলিশ ধরা হচ্ছে। তার খোঁজখবর করতেও বলা হয়েছে।’’

কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম ছিল, ইলিশের প্রজননে যাতে বাধা না পরে সে জন্য বর্ষার শুরুর থেকে দুর্গাপুজো পর্যন্ত সমুদ্রে মাছ ধরা যাবে না। পরে নিয়ম বদলে যায়। মৎস্যজীবীরাই জানালেন, সেই নিয়মে চলতি বছরেও ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত বন্ধ ছিল মাছ ধরার কাজ। বিজনবাবু বলেন, ‘‘আমরা মৎস্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছি, ওই জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে অথবা আগের নিয়মে দুর্গাপুজোর পরে মাছ ধরা চালু করতে হবে। তা না-হলে তিন-চার বছর পরে এ বাংলায় আর ইলিশ মিলবে না।’’

যেমন হয়েছিল বাংলাদেশেই। এ দেশের ইলিশ আমদানিকারীরাই জানালেন, বছর দশেক আগে বাংলাদেশেও ঠিক এমন ভাবে অবাধে প্রচুর ছোট ইলিশ ধরা হচ্ছিল। অবস্থা এমন হয় যে প্রমাণ সাইজের ইলিশ আর মিলছিলই না। বাংলাদেশ থেকে ফোনে ভারতের ইলিশ আমদানিকারী অতুলচন্দ্র দাস বলেন, ‘‘এর পরে ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম চালু করে হাসিনা সরকার। ছোট ইলিশ ধরা হলে জাল পুড়িয়ে দেওয়া, ট্রলারের লাইসেন্স বাতিল করা এবং মৎস্যজীবী ও ব্যাপারিদের জেল-জরিমানার নিয়মও হয়।’’ এর পরে বছর দুয়েক হল, ফের ও দেশে মিলছে বাংলা ইলিশ।

কী হবে এই বাংলায়? ‘খোঁজখবর’ আর ‘খতিয়ে দেখার’ সময়ের ফাঁকে বাংলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না তো সাধের ইলিশ? এ প্রশ্ন ব্যবসায়ীদেরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন