পুড়ল দুই সদ্যোজাত, দেখল না কেউ

শরীর উষ্ণ রাখতে গুরুতর অসুস্থ দুই সদ্যোজাতকে রাখা হয়েছিল ‘রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার’-এর তলায়। সেই যন্ত্রের মধ্যেই অতিরিক্ত উত্তাপে পুড়ে মৃত্যু হল তাদের। গত ২০ নভেম্বর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ)-এর এই ঘটনা রাজ্যে শিশু চিকিৎসার পরিকাঠামো নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৬
Share:

শরীর উষ্ণ রাখতে গুরুতর অসুস্থ দুই সদ্যোজাতকে রাখা হয়েছিল ‘রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার’-এর তলায়। সেই যন্ত্রের মধ্যেই অতিরিক্ত উত্তাপে পুড়ে মৃত্যু হল তাদের। গত ২০ নভেম্বর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিইউ)-এর এই ঘটনা রাজ্যে শিশু চিকিৎসার পরিকাঠামো নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। মৃত শিশুদের পরিবারের অভিযোগ, ওয়ার্মারের তাপমাত্রা ঠিকমতো নিয়ন্ত্রিত না-হওয়া এবং কোনও নজরদারি না থাকাতেই এত বড় খেসারত দিতে হল তাঁদের।

Advertisement

হাসপাতালের ইডেন বিল্ডিংয়ের তিনতলায় রয়েছে এসএনসিইউ। বিভাগের চিকিৎসক ও নার্সদের বক্তব্য, মেডিক্যালের মতো হাসপাতালে সব সময়েই এসএনসিইউয়ে অসুস্থ শিশুদের ভিড় থাকে। ফলে একটি রেডিয়েন্ট ওয়ার্মারে একাধিক শিশুকে রাখতে হয়। ২০ তারিখ রাতেও একটা ওয়ার্মারে তিনটি শিশু রাখা ছিল। তিন জনেরই জন্ডিস ছিল। তার মধ্যে একটি শিশুর শরীরের সঙ্গে লাগানো ছিল ওয়ার্মারের ‘প্রোব’ বা তাপমাত্রা নির্ণায়ক থার্মোমিটারটি। কোনও এক সময় সেই শিশুটির মা কোনও প্রয়োজনে প্রোবটি খুলে রেখে তাকে নিয়ে যান। কিন্তু তার পর প্রোবটি আর বাকি দুই শিশুর (একটি ছেলে ও একটি মেয়ে) মধ্যে কারও শরীরে লাগানো হয়নি। এখানেই ঘটে যায় বিপদ। ওয়ার্মার গরম হয়ে চলে। অথচ থার্মোমিটার খোলা থাকায় শিশু দু’টির শরীরের তাপমাত্রা যে হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে, যন্ত্রে তা আর ধরা পড়েনি। ফলে বিপদ ঘণ্টি বাজেনি। কারও নজরও পড়েনি ওয়ার্মারের দিকে। এসএনসিইউয়ের এক নার্সের কথায়, ‘‘যখন সবার হুঁশ হয়, তত ক্ষণে বাচ্চা দু’টো লাল হয়ে শক্ত হয়ে গিয়েছে। মুখে পাম্প করে, ভেন্টিলেশনে রেখেও আর কিছু করা যায়নি।’’

বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, রেডিয়েন্ট ওয়ার্মারের কার্যপদ্ধতির কথা মাথায় রেখেই তার থার্মোমিটার বা ‘প্রোব’টি সব সময়ে শিশুর গায়ে লাগিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক। সাধারণত ওয়ার্মারের তাপমাত্রা ৩৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে থাকে। শিশুর শরীরের তাপমাত্রা বুঝে ওয়ার্মার নিজের তাপমাত্রা ঠিক করে নেয়। যেমন, শিশুর দেহের তাপমাত্রা যদি ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তা হলে ওয়ার্মার বাড়তি সাড়ে তিন ডিগ্রি তাপ দেবে। একটি ওয়ার্মার যন্ত্রের সঙ্গে একটিই প্রোব থাকে। মেডিক্যালের ওই ওয়ার্মারে যে হেতু তিনটি শিশু ছিল, তাই তাদের মধ্যে যে কোনও এক জনের গায়ে প্রোব লাগানো ছিল। কিন্তু বিভাগের নার্স বা ডাক্তারদের উচিত ছিল, ওই শিশুটিকে তোলা মাত্রই বাকি দু’জনের মধ্যে যে কোনও এক জনের গায়ে প্রোবটি লাগিয়ে দেওয়া। না হলে খোলা থার্মোমিটার আশপাশের আবহাওয়া অনুযায়ীই রিডিং দেবে। সেই অনুযায়ী ওয়ার্মারের তাপমাত্রা বাড়বে। ঠিক সেটাই হয়েছে এসএনসিইউ-তে। তার উপর ঘরটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ওয়ার্মার বিনা বাধায় গরম হয়েছে। আর সেই অতিরিক্ত তাপে দগ্ধ হয়েছে শিশু দু’টি। চিকিৎসকদের একাংশ জানিয়েছেন, সময়ের আগে জন্মানো অসুস্থ সদ্যোজাতরা এতটাই দুর্বল হয় যে, তাপমাত্রার এতটা ওঠা-নামা তাদের বুঝতে পারার কথা নয়। তাই ওই সময়ে তারা কাঁদতেও পারেনি।

Advertisement

ঘটনার তিন দিন পর, ২৩ নভেম্বর মৃত শিশুর আত্মীয়রা লিখিত অভিযোগ করেন হাসপাতালের সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ির কাছে। ওই দিনই অধ্যক্ষের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করে। অধ্যক্ষ ও সুপার ছাড়াও কমিটিতে রয়েছেন নার্সিং সুপার কেয়া সামন্ত এবং এসএনসিইউয়ের প্রধান তাপস সাবুই। ঘটনার সময়ে এসএনসিইউয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের সোমবারই কমিটির সামনে হাজির হতে হয়েছে। অধ্যক্ষ তপনবাবু বলেন, ‘‘অভিযোগ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। রিপোর্ট জমা দেওয়ার তারিখ এখনও ঠিক হয়নি। নির্দিষ্ট পথে তদন্ত এগোতে হবে। আমি যখন মনে করব রিপোর্ট ঠিকঠাক তৈরি, তখনই স্বাস্থ্য ভবনে জমা দেব।’’

স্বাস্থ্য ভবনে এই রিপোর্ট জমা পড়ার কথা মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য গঠিত রাজ্যের বিশেষ টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান তথা এসএনসিইউয়ের নজরদারির জন্য গঠিত কমিটির প্রধান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি অবশ্য জানান, বৃহস্পতিবারের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ত্রিদিববাবুর কথায়, ‘‘খবর পাওয়া মাত্র উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। আমরা এসএনসিইউয়ের জন্য প্রাণপাত করছি। তার পরেও যদি কারও গাফিলতিতে এই ঘটনা ঘটে, তবে নিশ্চিত ভাবেই তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। রোগীর চাপে একটা যন্ত্রে একাধিক শিশুকে রাখতেই হবে। কিন্তু নজরদারিটাও সে ভাবে চালাতে হবে।’’ তবে যন্ত্রের কোনও সমস্যা থেকে দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ঘটনার পর থেকে কার্যত নজিরবিহীন গোপনীয়তার আবহ মেডিক্যাল কলেজে। স্ত্রীরোগ বিভাগের এক চিকিৎসক এবং এসএনসিইউয়ের দুই চিকিৎসকের দাবি, কর্তৃপক্ষ এবং বিভাগীয় প্রধান তাঁদের রীতিমতো হুমকি দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছেন। এমনকী তাঁদের আশঙ্কা, মুখ বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত শিশু দু’টি অন্য কোনও ভাবে মারা গিয়েছে বলেও হয়তো দেখিয়ে দেওয়া হতে পারে। পেডিয়াট্রিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান তথা এসএনসিইউয়ের প্রধান তাপস সাবুই প্রথমে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পরে বললেন, ‘‘কোথাও কোনও গাফিলতি হয়ে থাকলে তদন্তেই প্রকাশিত হবে। আপনাদের অত ভাবতে হবে না।’’ হাসপাতালের সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবার বক্তব্য, ‘‘তদন্ত কমিটিতে আমি রয়েছি, তবে বিষয়টি মূলত অধ্যক্ষই দেখছেন।’’

যে দুই সদ্যোজাতের মৃত্যু হয়েছে, তাদের এক জনের বাড়ি উত্তরপাড়ায়। অন্য জনের তালতলায়। উত্তরপাড়ার মৃত শিশুপুত্রের বাবার নাম অষ্টম বাগদি, মা সোনম দেবী। মঙ্গলবার দুপুরে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ঘটনার ধাক্কায় কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন সোনম। বেসরকারি চাকুরে অষ্টম জানালেন, ১৭ তারিখ তাঁদের সন্তান জন্মায়। সময়ের কিছু আগে প্রসব হওয়ায় এবং সদ্যোজাতের জন্ডিস দেখা দেওয়ায় তাকে এসএনসিইউয়ের ওয়ার্মারে রাখা হয়। অষ্টমবাবুর কথায়, ‘‘আমার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় বাচ্চার কাছে থাকতে পারেননি। আমাদের কাউকে সেখানে ঢুকতেও দেয়নি। আমার শাশুড়ি ২০ তারিখ রাত সাড়ে দশটায় শেষ বার ছেলেকে কৌটোর দুধ খাইয়ে এসেছিলেন। তখন সে একেবারে ঠিক ছিল।’’

অষ্টমবাবু জানান, ২১ তারিখ ভোর সাড়ে ৬টায় ডাক্তারেরা জানান, বাচ্চার অবস্থা খারাপ। পাম্প করে শ্বাস চালাতে হচ্ছে। বাচ্চা পুরো শক্ত হয়ে গিয়েছিল, নড়াচড়া করছিল না, শ্বাস পড়ছিল না। হাতের আঙুলগুলো কালো, শক্ত হয়ে বেঁকে ছিল। তাঁর দাবি, বিভাগের বেশ কিছু নার্স, ডাক্তার ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মী তাঁদের বাচ্চার পুড়ে যাওয়ার কথা গোপনে জানিয়েছিলেন। কিন্তু সামনে কেউই মুখ খুলছিলেন না। ওই রাতেই ডাক্তারেরা ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেন। তত ক্ষণে তার সারা শরীর, মুখ, ঠোঁট কালো হয়ে গিয়েছে। সরকারের কাছে এই ঘটনার বিচার চান অষ্টমবাবু।

একই কথা তালতলার মহম্মদ শাকিব ও তাঁর স্ত্রী অসরিমা খাতুনের। তাঁদের সদ্যোজাত শিশুকন্যাকেও জন্ডিসের জন্য ওয়ার্মারে রাখা হয়েছিল। শাকিবের কথায়, ‘‘২০ তারিখ রাতেও বাচ্চা একদম ঠিক ছিল। ২১ তারিখ গিয়ে দেখলাম, মুখ, হাত সব কালো। বাচ্চা শক্ত হয়ে রয়েছে। ডাক্তাররাও স্পষ্ট করে কিচ্ছু বলল না। ওয়ার্ডে সবাই বলছিল বাচ্চাগুলোকে বাল্বের নীচে রেখে আর ঠিক সময়ে নামিয়ে আনেনি। পুড়িয়ে মারল আমার ছোট্ট জানকে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন