ধুবুরিতে পুলিশি হেফাজতে ধৃত আবদুর নুর আহমেদ (বাঁ দিকে) এবং শাহনুর আলি। ছবি: রাজীব চৌধুরী
একটুর জন্য পুলিশের জালে পড়ল না শাহনুর আলম।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত, অসমের বরপেটার বাসিন্দা শাহনুর ওরফে ডাক্তার লুকিয়েছিল ধুবুরির বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া একটি গ্রামে। মঙ্গলবার রাত আড়াইটে নাগাদ পুলিশ সেখানে হানা দেওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে খবর পেয়ে শাহনুর পালিয়ে যায়। জামাতুল মুজাহিদিন জঙ্গি শাহনুরের হদিস পেতে পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। খাগড়াগড়ে ডেরা বেঁধে থাকা জঙ্গিদের হাতে শাহনুরের মাধ্যমে টাকা পৌঁছত বলে তদন্তে জেনেছেন গোয়েন্দারা।
ধুবুরির পুলিশ সুপার মৃদুলানন্দ শর্মা বলেন, “এনআইএ-র মোস্ট ওয়ান্টেড-দের তালিকায় থাকা শাহনুর অল্পের জন্য পালিয়ে যেতে পারল।” পুলিশের সন্দেহ, ধুবুরি থেকে পালিয়ে শাহনুর মেঘালয়-বাংলাদেশ সীমান্তের কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। নামাশেরসো গ্রামের পাশেই ভারত-বাংলাদেশ উন্মুক্ত নদী সীমান্ত। শাহনুরের সন্ধানে সীমান্ত বরাবর জোরদার তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। সতর্ক করা হয়েছে বিএসএফ-কেও।
শাহনুরের বাড়ি বরপেটা জেলার চটলা গ্রামে। আর তার খোঁজে মঙ্গলবার গভীর রাতে পুলিশ হানা দেয় ধুবুরির ফকিরগঞ্জের নামাশেরসো গ্রামে। চটলা থেকে নামাশেরসো গ্রামের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকার ওই গ্রামের অল্প দূরেই বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলা। পুলিশ সূত্রের খবর, ধুবুরির ওই গ্রামে গত ১৩ নভেম্বর ঢুকে শাহনুর প্রথমে তার এক কাকা আব্দুল হামিদের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল। তার দুই ছেলেকে (আবদুর নুর আহমেদ এবং শাহনুর আলি) পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানায়, আব্দুল হামিদের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একটি মোবাইল ফোন, যেটি শাহনুর কয়েক দিন ধরে ব্যবহার করেছিল।
শাহনুরের স্ত্রী সুজানাকে পুলিশ গত ৭ নভেম্বর গুয়াহাটি থেকে গ্রেফতার করেছিল। ওই মহিলাকে জেরা করেই শাহনুর সম্পর্কে পুলিশ কিছু তথ্য পায়। সেই সূত্র ধরে তিন দিন আগেই পুলিশ অভিযান শুরু করে ধুবুরির ওই চর এলাকায়।
খাগড়াগড় কাণ্ডে আর এক পলাতক অভিযুক্ত রেজাউল করিম মুর্শিদাবাদ জেলায় আত্মগোপন করে আছে বলে সন্দেহ করছে এনআইএ। রেজাউলের হদিস পেতে এনআইএ তিন লক্ষ টাকা ইনাম ঘোষণা করেছে। রেজাউল গত কয়েক বছর ধরে বর্ধমানের বাদশাহি রোডে থাকলেও তার আদি বাড়ি মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর শহর লাগোয়া খোদারামপুর ভূতবাগান গ্রামে। ওই গ্রাম লাগোয়া পিয়ারাপুর গ্রামের বাসিন্দা, পুরনো সহপাঠী আসিরউদ্দিন শেখকে সোমবার রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ ফোন করে রেজাউল। তার পর মঙ্গলবার আসিরউদ্দিনকে বার কয়েক ফোন করে রেজাউল তার বাড়ির খবরাখবর জানতে চায়। সে কথা রঘুনাথগঞ্জ থানায় জানিয়ে দেন সাইকেল মিস্ত্রি আসিরউদ্দিন। খবর যায় এনআইএ-র কাছে।
বুধবার দুপুরেই এনআইএ-র পাঁচ জনের একটি দল পৌঁছয় রঘুনাথগঞ্জে। প্রথমে সম্মতিনগরে এক ইটভাটা মালিক মহবুল হকের বাড়িতে তল্লাশি চালান গোয়েন্দারা। এনআইএ জানায়, সেই ঘরে দুই সন্দেহভাজন ব্যক্তি বেশ কিছু দিন ভাড়া ছিল। কিন্তু খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরেই হঠাত্ তারা সেখান থেকে চলে যায়। ওই ঘরে তল্লাশি চালিয়ে কিছু না পেলেও ওই ঘরটিতে তালা ঝুলিয়ে দেন এনআইএ-র অফিসারেরা। এর পর রঘুনাথগঞ্জ থানায় পিয়ারাপুরের আসিরউদ্দিনকে টানা চার ঘণ্টা গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পরীক্ষা করে তার মোবাইল ফোনের কললিস্ট।
গত কাল ঢাকায় প্রথমে সচিব পর্যায়ের ছয় সদস্যের একটি দল ও পরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটিলিয়ন (র্যাব)-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন এনআইএ-র প্রতিনিধিরা। ভারতের পক্ষ থেকে র্যাবের হাতে ১১ জন ফেরার বাংলাদেশি জঙ্গির নামের একটি তালিকা তুলে দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, কওসর, ইউসুফ শেখ, বোরহান শেখ, রিয়াজুল করিম, আমজাদ আলি শেখ, আব্দুল কালাম, শাহনুর আলম, হাবিবুর রহমান শেখ, হাতকাটা নাসিরুল্লা-র মতো সন্দেহভাজনদের সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হয়েছে ঢাকার কাছে। অন্য দিকে বাংলাদেশ মোট ৫১ জনের নামের তালিকা এনআইএ-র হাতে তুলে দিয়েছে, যারা ভারতে লুকিয়ে রয়েছে বলে সন্দেহ। এদের মধ্যে দশ জন জঙ্গি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে জেএমবি-র মাথা সানি, বোমারু মিজান ও ফারুক হোসেনকে একসঙ্গে দু’দেশই খুঁজছে। খাগড়াগড় মডিউলের মূল মাথা হিসাবে তারা ভারতে সক্রিয় ছিল। জঙ্গিদের সম্পর্কে দ্রুত তথ্য আদানপ্রদানে গুরুত্ব দিয়েছে দুই দেশই। এনআইএ কর্তারা বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের নিজেদের মোবাইল নম্বর দিয়ে জানিয়েছেন, যে কোনও তথ্য পাওয়া মাত্র তাঁরা যেন এই নম্বরে জানিয়ে দেন। তদন্তের কাজ দেখতে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের দিল্লিতে আমন্ত্রণও জানিয়েছে এনআইএ।