মমতার বিদ্রোহে সঙ্গী নীতীশ, জয়া, অখিলেশ

এক দিকে রাজ্যের বঞ্চনা, অন্য দিকে অতি-কেন্দ্রিকতা। এই দু’টি বিষয় নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্রোহে সমর্থন জানালেন দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৩২
Share:

—ফাইল চিত্র।

এক দিকে রাজ্যের বঞ্চনা, অন্য দিকে অতি-কেন্দ্রিকতা। এই দু’টি বিষয় নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদ্রোহে সমর্থন জানালেন দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement

নীতীশ কুমার, অখিলেশ যাদব, জয়ললিতা— পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরা জানিয়েছেন, রাজ্যের অধিকার খর্ব করতে নরেন্দ্র মোদীর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে তাঁর জেহাদ ঘোষণা করবেন। আপাতত ঠিক হয়েছে, জানুয়ারিতে সংসদের অধিবেশনের সময় দিল্লিতে এই মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে একটি চা-চক্র অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর মোদীর আক্রমণের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়ার চেষ্টা হবে।

তামিলনাড়ুর অর্থমন্ত্রী পনির সিলভম জানিয়েছেন, মমতা আন্তঃরাজ্য পরিষদের বৈঠকের সময় দিল্লিতে এসে এমনই একটি চা-চক্র করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আম্মা-ঘনিষ্ঠ নেতা জানান, এডিএমকে সেই প্রস্তাব সমর্থন করছে। মমতা শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠক করে মোদী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তিনি নীতীশ, অখিলেশ, জয়ললিতা, নবীন পট্টনায়কদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তামিলনাড়ুর অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রেরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।

Advertisement

কেন্দ্রের প্রকল্পগুলিকে একটি ছাতার নীচে নিয়ে এসে তার ৪০ শতাংশ অংশীদারি রাজ্যকে নিতে হবে— এমন প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন মমতা। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে এর প্রতিবাদ জানাবেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। রাজনৈতিক সূত্রের মতে, মোদী-বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ার চেষ্টা করছেন মমতা। আঞ্চলিক দলের নেতারা মনে করছেন, মোদীর সরকারকে নিয়ে এখন মানুষের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। আপাতত তাই কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়েই মোদী-বিরোধী মঞ্চ গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে।

উত্তরপ্রদেশের ভোটে বিজেপি ধাক্কা খেতে পারে, এমন আশা রাখছেন আঞ্চলিক দলগুলির নেতারা। সেই ভোটের পরেই কেন্দ্র-বিরোধী মঞ্চ গড়তে সক্রিয় হতে চান তাঁরা। যদিও নীতীশ কুমারের মন্তব্য, ‘‘আমরা তৃতীয় ফ্রন্ট বা চতুর্থ ফ্রন্ট গঠন করছি না। রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার শিকার আমরা সকলেই। সেই বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তোলাই লক্ষ্য।’’

বিজেপি অবশ্য সুকৌশলে প্রচার করছে, নীতি আয়োগ বা কেন্দ্রের অবস্থান নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাদের দলের মুখ্যমন্ত্রীদেরও দ্বিমত রয়েছে। এমনকী, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বিষয়ে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিরও ভিন্ন মত রয়েছে। তাদের দাবি, নীতি আয়োগের কমিটির সামনে সেই মতামত প্রকাশও করেছে তাদের রাজ্য সরকারগুলি। তবে বিরোধী নেতারা বলছেন, এটা আসলে বিজেপির কৌশল। ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁরা মমতা-নীতীশের মঞ্চে ঢুকে মোদী-বিরোধিতাকে লঘু করে দিতে চান।

নীতি আয়োগের এক মুখপাত্র অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্টা যুক্তি হাজির করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আয়োগ গঠনের পর সংস্থার পরিচালন পরিষদের প্রথম বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন না। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, নীতি আয়োগের সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মুখ্যমন্ত্রীরাই। তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা থাকবে না।’’ তিনি জানান, এর পর নীতি আয়োগ তিনটি কমিটি গঠন করে। এক, কেন্দ্রীয় প্রকল্প সংক্রান্ত কমিটি। দুই, স্বচ্ছতা সংক্রান্ত কমিটি। তিন, দক্ষতা উন্নয়ন সংক্রান্ত কমিটি। পশ্চিমবঙ্গ স্বচ্ছতা সংক্রান্ত কমিটির সদস্য হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কমিটির একটি বৈঠকেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আসেননি। আর কমিটি যে হেতু মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত, তাই সেখানে অন্য কেউ প্রতিনিধিত্বও করতে পারেন না।

নীতি আয়োগের ব্যাখ্যা হল, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সংখ্যা ২০০ থেকে কমিয়ে ৬৬ করা হয়েছিল। তার পর সেগুলি এক ছাতার তলায় এনে ২৮টি প্রকল্প হয়েছে। এখানে রাজ্যের অংশীদারি কী হবে, সে-সব মুখ্যমন্ত্রীরাই ঠিক করেছেন। মমতা যদি বৈঠকে না আসেন, তা হলে সিদ্ধান্তের পর তিনি প্রশ্ন তুলছেন কী ভাবে? আর এই বিতর্কে মোদী শিবিরের যুক্তি, চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাজ্যগুলিকে সংগৃহীত রাজস্বের ৪২ শতাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ নিয়ে রাজ্যের আপত্তি থাকতেও পারে। কিন্তু সে জন্য মোদী দায়ী নন। কেননা, তিনি সুপারিশ কার্যকর করেছেন মাত্র। তাঁদের মতে, নীতি আয়োগের যে চিঠি মমতার কাছে গিয়েছে, সেটি নতুন কিছু নয়। ২০১৫ সালের অক্টোবরে নীতি আয়োগের তিনটি কমিটি রিপোর্ট জমা দেয় সরকারের কাছে। সম্প্রতি এই সুপারিশগুলি মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। নীতি আয়োগ সেই সম্মতির কথা মুখ্যমন্ত্রীদের জানিয়েছে মাত্র।

মমতার বিদ্রোহ অবশ্য নীতি আয়োগ নিয়ে নয়। ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে রাখা থেকে সিবিআই বা আয়কর বিভাগকে ‘লেলিয়ে দেওয়া’-র মতো বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। নীতি আয়োগ প্রতিষ্ঠার পর বাৎসরিক যোজনা বরাদ্দ উঠে যাওয়ায় যোজনা খাতে রাজ্য যে আর টাকা পাচ্ছে না— তা নিয়েও বিভিন্ন রাজ্যের অসন্তোষ চরমে। তবে এ ব্যাপারেও নীতি আয়োগের বক্তব্য, যোজনা বরাদ্দস্থির করার মধ্যে রাজনৈতিক চাপ ও পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি অনেক সময় কাজ করত। এখন তা বন্ধ হয়েছে।

এই বিতর্ক নিয়ে কংগ্রেস মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারি বলেন, ‘‘আমরা প্রতিযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে। তবে যে ভাবে মোদী গোটা বিষয়টিকে অতি-কেন্দ্রিকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আঘাত পড়ছে। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীরাও এই প্রশ্নে একমত।’’

এ দিকে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্রমণের জবাব দিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। সোমবার তিনি বলেন, ‘‘উনি বলছেন, প্রধানমন্ত্রীকে মানেন না। আমরাও কি বলতে পারব, মুখ্যমন্ত্রীকে মানি না? এ ভাবে বলা যায়? সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এই ধরনের অসম্মানজনক উক্তি আসলে গণতন্ত্রের প্রতিই অপমান!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন