তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার গাঁধী মূর্তির পাদদেশে। ছবি: সুমন বল্লভ।
মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগেই যিনি শিক্ষক-উপাচার্যদের কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করেছেন, চাপের কাছে মাথানত করবেন না। সরকার তাঁদের সঙ্গে আছে। ছিলেন শঙ্কুদেব পণ্ডা। শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার দাপটে শিক্ষক-উপাচার্যেরা নিরন্তর ‘চাপে’ থাকেন! ছিলেন কলেজে কলেজে শাসক দলের সংগঠন করা হাজার হাজার শিক্ষার্থী। অথচ মঞ্চের প্রধান চরিত্রই চিত্রনাট্য গুলিয়ে ফেললেন!
রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্র জুড়ে দৈনন্দিন নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে একটি শব্দও খরচ করলেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি)-র বাৎসরিক সমাবেশে ছাত্র নেতৃত্বকে সতর্ক করা দূরের কথা, সংযত হওয়ার বার্তাটুকুও দিলেন না শাসক দলের সর্বময় নেত্রী। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সম্মান করা উচিত, এই আপ্তবাক্য অবশ্য তাঁর বক্তব্যে ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে ছিল এই কথাও “১৮ বছর বয়সে প্রাণশক্তি, উদ্দীপনা, উচ্ছ্বলতা বেশি থাকে এবং তা ছোট করে দেখা ঠিক নয়।” মুখ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে তরুণ ছাত্র নেতৃত্বের কাজকর্মের প্রতি কোনও প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় থাকল কি না, পরিস্থিতি বিচারে স্বভাবতই উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্ন! প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে, যখন দলনেত্রীর বক্তব্যের পরে বৃহস্পতিবার টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে বুঝলাম, কুৎসা করে টিএমসিপি-কে আটকানো যাবে না!”
শিক্ষাঙ্গনে প্রায় প্রতিদিনের ধারা মেনে বৃহস্পতিবারও পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরে শিক্ষকদের তালাবন্ধ করে রাখার অভিযোগ উঠেছে টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে। কোচবিহারের পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় অনিয়মের জেরে নিয়োগের গোটা প্যানেল বাতিল করতে হয়েছে। সেখানেও স্বজনপোষণে অভিযুক্ত তৃণমূলের বিধায়ক। ছাত্র সংগঠনের দাপটে জেরবার শিক্ষক-অধ্যাপকদের কারও না কারও প্রায় রোজই পদত্যাগ করতে চাওয়ার ইচ্ছা তো আছেই। রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রে ঘটে চলা এ সব কোনও ঘটনারই প্রতিফলন কলকাতা ময়দানে গাঁধী মূর্তির পাদদেশে শাসক দলের ছাত্র সমাবেশে পড়ল না!
তাঁরা বলেন... সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।
ছাত্র সংগঠনকে সংযত করার কোনও বার্তাই না দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী বরং উপদেশ দিলেন, তাঁর সরকার ও দলের বিরুদ্ধে যাবতীয় কুৎসা ও অপপ্রচারের জবাব দিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সোস্যাল নেটওয়ার্কে আরও সক্রিয় হতে হবে! ‘অপপ্রচারে’র জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্র-সমাবেশের মঞ্চকেই বেছে নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী সেখানে জানিয়েছেন, তাঁর সিঙ্গাপুর সফরে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা নিজেদের খরচে গিয়েছিলেন। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন।
কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে এ দিনই সবংয়ে দলের বর্ষীয়ান নেতা মানস ভুঁইয়া প্রশ্ন তুলেছেন, “শিক্ষামন্ত্রী বদলে গিয়ে ব্রাত্য থেকে পার্থ হলেন। কিন্তু শিক্ষক-অধ্যাপকেরা রক্তাক্ত হচ্ছেন, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এই পরিবর্তন কি আমরা আনতে চেয়েছিলাম? শিক্ষা ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ কি এখন শাসক দলের ছাত্র নেতাদের হাতে?” ঠিক এই প্রশ্নেরই জবাব এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশা করেছিল শিক্ষা জগৎ। বাস্তবে তাঁর কাছ থেকে উত্তর তো নয়ই, শিক্ষক বা ছাত্রদের কাছে শিক্ষামন্ত্রীর মতো আবেদনটুকুও মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে শোনা গেল না!
মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘নীরবতা’কে চোরকে চুরি করা এবং গৃহস্থকে সতর্ক থাকতে বলার কৌশল হিসাবেই ব্যাখ্যা করছেন সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম। তাঁর কথায়, “বেশির ভাগ সময় কিছু ঘটলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন তুচ্ছ ঘটনা। আর এ বার শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু ঘটছে বলেই স্বীকার করলেন না! এতে বোঝা যায়, যাঁরা শাসক দলের ছাত্র সংগঠন করছেন এবং যাঁরা সংগঠন চালাচ্ছেন, তাঁরা এটাই চান!”
সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে ছাত্র নেতাদের হুঁশিয়ারি না দিলেও মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন বোঝাতে চেয়েছেন, কলেজে কলেজে ছাত্র-অশান্তি এখন আগের চেয়ে অনেক কম। তাঁর বক্তব্য, “যোগমায়া দেবী কলেজে যখন ছাত্র পরিষদের ইউনিট খুলেছিলাম, তখন একটা দিনও যেত না যে দিন এসইউসি-র মেয়েরা এসে আমাদের মারত না! বা সিপিএম অশান্তি করত না। কিন্তু এখন গণ্ডগোল অনেক কম।” বিরোধীরা বলছেন, ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়মিত ঘটছে না ঠিকই। তা বলে শিক্ষাঙ্গন সমস্যামুক্ত, তা তো নয়! মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনেককেই হতাশ করেছে বুঝে শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতাও মেনে নিচ্ছেন, “দিদি সে ভাবে শিক্ষার মধ্যে ঢুকলেন না! অন্য রাজনীতির কথাই যেন বেশি হয়ে গেল!”
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বেশি আক্রমণ করেছেন সিপিএমের ‘উচ্ছিষ্ট’ ও বিজেপি-র ‘ভৈরব বাহিনী’কে। শাসক দল ও তার ছাত্র সংগঠনের সমালোচকদের ‘নিরপেক্ষ নয়, কুৎসাপক্ষ’ বলে এক হাত নিয়েছেন!
আগের দিনের মতো না হলেও শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবু তবু কিছুটা শিক্ষা ক্ষেত্রে ঢুকেছিলেন তাঁর বক্তব্যে। পার্থবাবু এ দিন বলেছেন, “আমরা যখন কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনের বার্তা প্রচার করব, তখন খেয়াল রাখতে হবে সেই প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠন, নিয়মানুবর্তিতা, সর্বাঙ্গীন উন্নতির উপরে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রচার করতে হবে, রাজ্যের মেধা রাজ্যেই রাখব।” সরকারের ভাল কাজের খতিয়ান দিয়ে পার্থবাবু বলেন, “এমন কিছু করব না, যাতে শত্রুরা ভাল কাজগুলিকে চাপা দিতে পারে।”
প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা এ দিনই ফের অভিযোগ করেছেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মহাজাতি সদনের সামনে মঞ্চ বেঁধে ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের সভায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী অভিযোগ করেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে স্টক এক্সেচেঞ্জে পরিণত করেছে! এখন টাকা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো হয়।” দলের সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের দাবি, সিপিএম আমলে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে রাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হত। এখন তপসিয়ার তৃণমূল ভবন থেকে তা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে অবিলম্বে ছাত্র পরিষদকে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেন নেতারা।
তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গাঁধীমূর্তির সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ সব প্রসঙ্গে যাননি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দমতো ছাত্রভর্তি বা টোকাটুকির দাবিতে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রতিবাদ জানাতে টিএমসিপি-র জঙ্গি পথ কী সমস্যা তৈরি করছে, তা মুখ্যমন্ত্রীর অজানা নয়।
শিক্ষামন্ত্রী তো বটেই, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও এর আগে টিএমসিপি-কে সংযত থাকার বার্তা দিয়েছেন। টিএমসিপি-র জন্য তৃণমূল ক্ষমতায় আসেনি, তাই তাদের জন্য দল কেন বিড়ম্বনায় পড়বে, সেই প্রশ্নও দলের বৈঠকে তুলেছিলেন মুকুলবাবু।
অথচ এ দিন ছাত্র সমাবেশের মঞ্চে মমতা বলেছেন, “সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী বিজেপি-র ভৈরব বাহিনীর সঙ্গে মিলে গুন্ডামি করে বেড়াচ্ছে। যারা উচ্ছিষ্টের দল, তাদের উচ্ছিষ্ট করতে দিন! আমরা উন্নয়নের দল। যারা ছাত্র রাজনীতি করে, তারা হারে না, পিছনে দেখে না। বীরের মতো এগিয়ে যায়। আপনারা বীরের মতো এগিয়ে চলুন!” অধ্যক্ষদের অনেকের আশঙ্কা, টিএমসিপি-কে সংযত হওয়ার বার্তা না দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, তাতে কার্যত তাদের দাদাগিরিকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আর শঙ্কুদেব যা বুঝেছেন বলে দাবি, তাতে এ বার টিএমসিপি-কে রোখা সত্যিই কঠিন হবে বলে আশঙ্কা অধ্যক্ষদের বড় অংশের!
ইংরেজির এমেরিটাস অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ সুকান্ত চৌধুরীর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী মুখে কিছু বলেননি বলে খুব একটা ক্ষতি হয়েছে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। শিক্ষামন্ত্রী তো বলছেন। কী লাভ হচ্ছে তাতে? আসল জায়গায় বার্তাটা পৌঁছচ্ছে না।” তাঁর মতে, বিভিন্ন সময়ে সরকার এমন পদক্ষেপ করেছে, যাতে আসল জায়গায় বার্তা পৌঁছচ্ছে না। স্নাতক স্তরে অনলাইন চালু না করা তেমনই এক পদক্ষেপ বলে মত এই প্রবীণ শিক্ষকের। জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রাক্তন ডিরেক্টর-জেনারেল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক স্বপন চক্রবর্তীর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী পেশাদার রাজনীতিক। উনি কী বলবেন, না বলবেন, সেটা উনিই ঠিক করবেন। কিন্তু আমার মতে, শিক্ষা ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনীতি চলতে পারে। ঘেরাওয়ের মতো শারীরিক নিগ্রহ যেন বন্ধ হয়, তা দেখতে হবে।” কিছুটা সুকান্তবাবুর সুরে স্বপনবাবুরও বক্তব্য, “শিক্ষামন্ত্রীর বুধবারের বক্তব্যকে সমর্থন করি। কিন্তু কেবল বলে গেলাম, তাতে কাজ কিছু হল না, তা হলে কী লাভ!”
কী শিখলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে? শঙ্কুদেবের জবাব, “অধ্যক্ষ-অধ্যক্ষাদের সম্মান করব। শিক্ষকদের কেউ কেউ অবশ্য ষড়যন্ত্র করতে পারেন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে!”