গ্রামে সন্ত্রাস রোখার সংগঠন কোথায়

পুরভোটের টিকিট পাওয়া নিয়ে খাস কলকাতায় এক দলের রাজ্য দফতরের সামনে বিক্ষোভ-হাতাহাতি। আর এক দলের নবগঠিত রাজ্য কমিটির প্রথম বৈঠকেই ‘সন্ত্রাসের’ বাতাবরণে কর্ম়ী-সমর্থকদের মনোবলে ধাক্কা লাগছে কি না, তা-ই নিয়ে চাপান-উতোর। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, মূলত গ্রামাঞ্চল ঘেঁষা পুর-এলাকায় শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠাও বন্ধ হয়নি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৩
Share:

তুফানগঞ্জে জখম বিজেপি সমর্থক যুধিষ্ঠির পাল। — নিজস্ব চিত্র

পুরভোটের টিকিট পাওয়া নিয়ে খাস কলকাতায় এক দলের রাজ্য দফতরের সামনে বিক্ষোভ-হাতাহাতি। আর এক দলের নবগঠিত রাজ্য কমিটির প্রথম বৈঠকেই ‘সন্ত্রাসের’ বাতাবরণে কর্ম়ী-সমর্থকদের মনোবলে ধাক্কা লাগছে কি না, তা-ই নিয়ে চাপান-উতোর। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, মূলত গ্রামাঞ্চল ঘেঁষা পুর-এলাকায় শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠাও বন্ধ হয়নি। বৃহস্পতিবারও কোচবিহারের তুফানগঞ্জে বিজেপি কর্মীকে মারধর, সিপিএম সমর্থকের বাড়িতে হামলার অভিযোগ উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে ধন্দে পড়েছেন বিজেপি এবং সিপিএমের নিচুতলার কর্ম়ী-সমর্থকদের একটা বড় অংশ।

Advertisement

জেলা সদর থেকে দূরের এলাকায় দলের তরফে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সদর্থক পদক্ষেপ করা হচ্ছে না কেন, বিজেপি বা বাম কর্মী-সমর্থকদের ধন্দ তা নিয়েই। সন্ত্রাস মোকাবিলা করার মতো সংগঠন তাঁদের আদৌ আছে কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে কংগ্রেসের অনেক নেতা-কর্মীর মধ্যেও। ঘনিষ্ঠ মহলে অনেকে বলতেও শুরু করেছেন, ‘‘সংগঠন দুর্বল বলে আমরা সন্ত্রাসের কাঁদুনি গাইছি, এমনটাই দাবি করছে তৃণমূল। মনে হচ্ছে, তা যেন গ্রহণযোগ্যতাও পেয়ে যাচ্ছে!’’ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন এ দিনও বলেছেন, ‘‘আসলে দল টেকাতে, কর্মীদের ধরে রাখতে তো একটা কিছু করতে হবে। তাই বিরোধীরা সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলছেন!’’

বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের একটা বড় অংশের মধ্যে এই নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে বীরভূমে। লোকসভা ভোটের পরে এই জেলার উপরে ভর করেই এ রাজ্যে বিজেপির ডানা মেলা শুরু। ইলামবাজারে দলীয় কর্মী খুন নিয়ে আন্দোলন, পাড়ুইয়ে তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ অংশকে (হৃদয় ঘোষ-সহ) দলে সামিল করার মতো ঘটনার জেরে নিয়মিত সংবাদ শিরোনামে ছিল জেলা বিজেপি। তাল কাটল ২২ মার্চ। সে দিন রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ জানিয়ে দলের জেলা সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলেন পোড় খাওয়া বিজেপি নেতা দুধকুমার মণ্ডল। ওই দিনই সিউড়িতে দলীয় কার্যালয়ে প্রার্থীতালিকা ঘোষণা করতে যাওয়া বিজেপির জেলা পর্যবেক্ষককে ঘিরে তুমুল বিক্ষোভ হয়। পার্টি অফিসে ভাঙচুরও চালান টিকিট প্রত্যাশীরা।

Advertisement

ঘনিষ্ঠদের মধ্যে আলোচনায় বীরভূমে বিজেপি-র বহু নিচুতলার কর্মী মেনে নিচ্ছেন, ‘‘দু’টো ঘটনাতেই প্রভাব পড়েছে দলের অন্দরে।’’ বলছেন, ‘‘একটা সময় জেলায় আমরা তৃণমূলের সঙ্গে প্রায় সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার জায়গায় চলে গিয়েছিলাম। এখন বোলপুর, রামপুরহাট, সাঁইথিয়াতে আমাদের প্রচারে শাসক দল বাধা দিলেও আমরা কিছুই করিনি। কী মানে হয় এর?’’

পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দুধকুমার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, স্থানীয় সমস্যা নিয়ে দলের কর্মী-সমর্থকদের সাহায্য করতে গিয়ে দলের রাজ্য নেতৃত্বকে পাশে পাননি। এমনকী, জেলায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তৈরি করে সংগঠনের শক্তিকে ভাঙতে নেতৃত্বের একাংশ প্রত্যক্ষ মদত দিয়েছে বলেও তিনি সরব হন। নেতারা সে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও রাজ্যবাসী দেখেছেন, টিকিট না মেলা নিয়ে বিজেপির অন্দরের সমস্যাই পরে বড় আকারে আছড়ে পড়ে কলকাতায় দলের রাজ্য দফতরে। যদিও বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার বৃহস্পতিবার দাবি করেছেন, ‘‘দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে নিয়ে শাসক দল ফলাও করে আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার তত্ত্ব প্রচার করছে। দুর্বলতা কোথায়, দল তো কলেবরে বাড়ছে!’’

রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের একটা বড় অংশ কিন্তু বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের এই দাবির সঙ্গে সহমত নন। তাঁদের বিশ্লেষণ, সারদা কাণ্ড বা খাগড়াগড়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বদলে জেলা স্তরের স্থানীয় দাবিদাওয়াকে যে ভাবে সামনে তুলে আনার প্রয়োজন ছিল, বিজেপির তরফে তাতে কোথাও খামতি থেকে গিয়েছে। এ রাজ্যে বিজেপির উপস্থিতি নিতান্ত বায়বীয় নয় বলে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষকে যে ভরসা দেওয়া দরকার ছিল, তা-ও পর্যাপ্ত মাত্রায় হয়নি। উল্টে সে কথাগুলো কিছুটা ঢাকা পড়ে গিয়েছে একটি বিধানসভায় জয় আর উপনির্বাচনগুলিতে ভোট-শতাংশ বাড়ার উল্লাসে।

এই পর্যবেক্ষণের সমর্থন মিলেছে নদিয়ার গয়েশপুরে কিছু বিজেপি কর্মীর কথায়। যাঁদের ক্ষোভ, ‘‘এখানে আমাদের মহিলা প্রার্থীর বাচ্চার মাথায় বন্দুক ধরে মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করল শাসক দল। অথচ রাজ্য নেতাদের কেউ এখানে এলেন না। কোন সাহসে রুখে দাঁড়াব বলতে পারেন?’’ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিজেপির অন্দরে নেতাদের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে টিকিট বিক্রি, দলের দীর্ঘদিনের সৈনিকের পরিবর্তে অন্য দল থেকে আসা কিছু নেতার প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ। তাই বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ পুরভোট থেকে বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত রাজ্যে রণকৌশল ঠিক করতে ‘কোর গ্রুপ’ গড়িলেও, দলের সর্বস্তরে আস্থার বার্তা পৌঁছচ্ছে না। এই ইঙ্গিত স্পষ্ট রাজ্যে বিজেপির একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথাতেও। শমীক বলেন, ‘‘আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। কে ঘরে বসে ফোন করে সদস্য হয়ে গেল, তা নেতৃত্ব জানল না। এদের রাজনৈতিক অতীত জানি না, কী পারে-না পারে জানি না। এই সদস্যদের উপরে নির্ভর করে তৃণমূলের সন্ত্রাস রোখা যায় না।’’

কিন্তু রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপির প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা তো সাম্প্রতিক ঘটনা। বামেদের দীর্ঘদিনের সংগঠনের অন্দরেও কর্মীদের ভয় পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন? গয়েশপুর পুর-এলাকায় সব প্রার্থী প্রত্যাহারের মতো দিন কেন দেখতে হচ্ছে সমর্থকদের?

শাসক দলের সন্ত্রাস এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগের বাইরেও মিলছে নানা কারণ। যেমন, বাম নেতাদের একাংশের বক্তব্য— কলকাতা, হাওড়ার মতো জেলায় তাঁদের সাংসদ বা বিধায়ক নেই। পুরভোট ঘোষণা হতেই সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠা নদিয়ায় তিন আর হুগলিতে দু’জন বিধায়কই সম্বল। ফলে এ সব জেলায় জনপ্রতিনিধিভিত্তিক সংগঠন তৈরির প্রক্রিয়া মার খাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বাম আমলে যে সব এলাকায় ভোটের আগে-পরে সন্ত্রাস দেখতে অভ্যস্ত ছিল জনতা, সে সব জায়গায় এখন বামেদের অভিযোগের প্রতি মানুষের সহানুভূতি নেই। ‘যেমন করেছ, তেমনই পাচ্ছ’, এমনই মনোভাব। তা ছাড়া স্থানীয় নেতাদের অনেকেই আর ঝামেলায় জড়াতে চান না। ফলে, কিছু ঘটলে আক্রান্তদের সাহায্যের হাত বাড়ানোর লোকেরও অভাব হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশও পাছে পুরনো মামলার সূত্রে বিপাকে পড়েন, তাই ভেবে সরাসরি বিরোধিতার রাস্তায় যেতে নারাজ।

সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম অবশ্য এই পরিস্থিতির জন্য আঙুল তুলছেন শাসক দলের দিকেই। বলছেন, ‘‘আমাদের সময় অন্যায়, বাড়াবাড়ি হয়নি এমন দাবি কখনও করিনি। কিন্তু বামফ্রন্ট যদি সব কিছু জোর করেই দখল করত, তা হলে তৃণমূল তৈরি হওয়ার দু’বছরের মধ্যে কলকাতা পুরসভায় ক্ষমতায় এল কী ভাবে?’’ তাঁর সংযোজন: ‘‘ভোট ঘোষণার দিন থেকে বিরোধীদের কিছু করতে দেব না— এমন মানসিকতা এ রাজ্যে ছিল না।’’ দলের উত্তর ২৪ পরগনার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং রাজ্য কমিটির সদস্য নেপালদেব ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন জেলায় ৫৮৭টা ওয়ার্ডে ভোট হচ্ছে। তার মধ্যে প্রার্থী তুলে নিতে হয়েছে এমন ওয়ার্ডের সংখ্যা কুড়ির বেশি নয়। বলছেন, ‘‘যদি আমাদের সংগঠন না থাকত, তা হলে তো কোথাও প্রার্থীই দিতে পারতাম না। সংগঠন দারুণ সবল এমন দাবি করছি না। কিন্তু তা বলে আমাদের প্রচারে বাধা দিতে তৃণমূল যা করছে, তাকে বিরোধীদের সাংগঠনিক দুর্বলতা বলে আড়াল করা যায় না।’’

সংগঠন থাকলে শাসক দলের সন্ত্রাস প্রতিহত করা যাচ্ছে না কেন? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের দাবি, ‘‘আমরা আইনের পথে সন্ত্রাসের মোকাবিলা করছি। মানুষকে সংগঠিত করতে পথসভা, মিছিল করছি। দলের রাজ্য নেতৃত্ব পথে নেমে প্রতিবাদ করছেন।’’

যদিও নিচুতলার বাম-কর্মীদের একটা বড় অংশ বলছেন, ‘‘শহরাঞ্চলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কর্মসূচি হতে পারে। কিন্তু রাজ্যস্তরের নেতারা তো নিয়মিত ভাবে গ্রাম লাগোয়া এলাকার পাড়ায়-পাড়ায় ভোট-প্রচারে যাবেন না। সেখানে শাসক দলের মুখোমুখি তো আমাদেরই হতে হবে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন