BJP’s Poll Strategy

হাঁকডাক নয়, তিনটি অঙ্ক আর তিনটি কৌশলে ভোট বৈতরণী পার হতে চায় বিজেপি, হিসাব মেলা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন অনেক

এসআইআরে মাধ্যমে ভোটার তালিকা ঝাড়াই-বাছাই হয়ে গেলে তৃণমূলের ঠিক কতটা ক্ষতি, তার স্পষ্ট হিসাব বিজেপি নেতাদের কাছে এখনও নেই।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:০০
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

২০২১ সালের ৯ এপ্রিল। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারযুদ্ধ তুঙ্গে। কয়েক দফা ভোটগ্রহণও হয়ে গিয়েছে। মধ্যমগ্রামে বৈকালিক রোড শো শেষ করে সদ্য অমিত শাহ রওনা হয়েছেন বিমানবন্দরের দিকে। দিল্লি থেকে আগত বিজেপির এক ‘মিডিয়া ম্যানেজার’ মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে পরিচিত এক স্থানীয় বাসিন্দাকে প্রশ্ন করলেন, ‘‘মধ্যমগ্রামের ফলাফল কী হবে?’’ নির্বিকার জবাব এল, ‘‘আপনারা হারবেন।’’ চিন্তিত বিজেপি পদাধিকারী বলেছিলেন, ‘‘হারব কেন? জাঁকজমক তো ভালই হল!’’

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন সম্পর্কে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্বের ধারণা কেমন ছিল, ওই কথোপকথনে তার আভাস ছিল। কিন্তু পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বিজেপির সেই পূর্ববর্তী ধারণায় বদলের আভাস মিলছে। হাঁকডাক কম। ‘যোগদান মেলা’ করে বা চার্টার্ড বিমানে উড়িয়ে দলবদল করানো নেই। প্রধানমন্ত্রীকে নরেন্দ্র মোদীকে দিয়ে মুড়ি-মুড়কির জনসভা করানোর পরিকল্পনাও আপাতত মুলতুবি।

বিজেপি বলছে, হাঁকডাকের নির্বাচন নয়। এ বার অঙ্ক আর কৌশলের নির্বাচন। তিন অঙ্ক এবং তিন কৌশল।

Advertisement

অঙ্ক ১: এসআইআর। সর্বশেষ নির্বাচনের তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এবং বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে ফারাক ৪১ লক্ষের আশপাশে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল প্রায় ২ কোটি ৩৩ লক্ষ ভোট। তৃণমূল পেয়েছিল ২ কোটি ৭৪ লক্ষের মতো। বিজেপি মনে করছে, ‘অস্তিত্বহীন’ ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার পরে ভুয়ো ভোট দেওয়ার অবকাশ কমে যাবে। তৃণমূল আর বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে যা ব্যবধান, তার চেয়ে অনেক বেশি নাম ভোটার তালিকা থেকে ইতিমধ্যেই বাদ পড়ে গিয়েছে বলে কমিশন সূত্রের দাবি। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

অঙ্ক ২: অবাধ, শান্তিপূর্ণ এবং স্বচ্ছ ভোটগ্রহণ এবং গণনা নিশ্চিত করা। তার জন্য নির্বাচন কমিশনের কঠোর ভূমিকা, নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসাবে ‘কঠোর’ আধিকারিক পাঠানো, কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি বদল-সহ একগুচ্ছ দাবি কমিশনে ইতিমধ্যেই বিজেপি পেশ করেছে। এ সবের মাধ্যমে ভোটের দিন বুথে এবং বুথের বাইরে সন্ত্রাসের আবহ রোখা গেলেই ‘কেল্লা ফতে’ বলে বিজেপি নেতারা হিসাব কষেছেন।

অঙ্ক ৩: শুধু তৃণমূলের ভোট কমানো নয়, নিজেদের ভোট বৃদ্ধি নিয়েও অঙ্ক কষছে বিজেপি। রাজ্য বিজেপির প্রথম সারির একাধিক নেতার ‘বিশ্বাস’, এ বারের নির্বাচনে বিজেপির ভোট আগের চেয়ে কিছুটা বাড়বে। কারণ, বাম-কংগ্রেসের ভোট আগের চেয়েও কমবে এবং তা বিজেপির ঝুলিতেই জমা হবে।

তবে বিজেপির এই তিনটি অঙ্কের একটিও পুরোপুরি মিলবে কি না, সে বিষয়ে কোনও নিশ্চয়তা নেই। প্রথমত, এসআইআর-এর মাধ্যমে ভোটার তালিকা ঝাড়াই-বাছাই হয়ে গেলে তৃণমূলের ঠিক কতটা ক্ষতি, তার স্পষ্ট হিসাব বিজেপি নেতাদের কাছে এখনও নেই। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় বাহিনীর এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে প্রতি বছরই ভোটের আগে বিজেপি নেতৃত্ব আশাবাদী থাকেন। কিন্তু ভোটের দিনের হালহকিকত দেখে প্রতিবারই নিরাশ হয়ে পড়েন। তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে ইতিমধ্যেই প্রান্তিক হয়ে যাওয়া বাম-কংগ্রেসের থেকে কত ভোট বিজেপি টানতে পারবে, শতাংশের বিচারে তা কতটুকুই বা হবে, তা-ও ভাবার বিষয়।

এই তিনটি অঙ্ক মেলাতে বিজেপি তিনটি কৌশলও নিয়েছে।

কৌশল ১: মোদীর মুখ। টানা সাড়ে ১১ বছর প্রধানমন্ত্রিত্বে থাকা এবং পর পর অনেকগুলি নির্বাচনে বিজেপিকে সাফল্য পাইয়ে দেওয়ার সুবাদে মোদীর যে ভাবমূর্তি, তাকে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে আরও একবার ব্যবহার করা। বিজেপির ‘সুশাসন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ মোদীকে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতি, অপশাসন এবং আইনশৃঙ্খলাহীনতা’র অভিযোগ তোলানো।

কৌশল ২: রাজ্যের বর্তমান সম্পর্কে শুভেন্দু অধিকারীর ‘আগ্রাসী ভাষ্য’। কট্টর হিন্দুত্ব, তৃণমূলকে আগ্রাসী আক্রমণ এবং মমতা তথা তৃণমূলের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সহযোগে নানা অভিযোগ তোলা— শুভেন্দু এই কাজটি চালিয়ে যাবেন। এবং ক্রমশ সুর চড়াবেন।

কৌশল ৩: রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শমীক ভট্টাচার্যের ‘বাস্তববাদী ভাষ্য’। রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা, লগ্নির বহির্গমন, কর্মসংস্থানহীনতা নিয়ে শমীক নিত্য কথা বলে চলেছেন। এই ভাষ্যকেই শমীক তুঙ্গে তুলবেন এবং পরিকাঠামো উন্নয়ন, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের কিছু স্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরবেন।

কিন্তু এরই পাশাপাশি এই প্রশ্নও বিজেপির অন্দরে উঠছে যে, এমত কৌশল কি আদৌ নতুন? এর আগের বিধানসভা নির্বাচনেও মোদীর মুখকে বিজেপি যথেচ্ছ ব্যবহার করেছিল। সুশাসন, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ভাষ্য বিজেপি আগের বিধানসভা নির্বাচনেও শুনিয়েছিল। শুভেন্দুও এখনকার চেয়ে কিছু কম আগ্রাসী ছিলেন না। রাজ্য বিজেপির এক প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদকের ব্যাখ্যা, ‘‘আগের বার মোদীজির প্রচারের ভাষ্য অন্য রকম ছিল। ‘দিদি, ও দিদি’ ডাকে কটাক্ষের স্বর ছিল। এ বার মোদীজি অন্য রূপে। ইতিমধ্যেই তিনি যে সভাগুলি করেছেন, সেখানে তাঁর ভাষণের ওজন গত বারের চেয়ে আলাদা।’’ শুভেন্দুও এখন বিজেপি কর্মীদের কাছে আগের বারের চেয়ে ‘অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং আস্থার পাত্র’ বলে ওই নেতার ব্যাখ্যা। শুধু তা-ই নয়, ২০২১ সালের নির্বাচনে নন্দীগ্রামে মমতাকে হারিয়ে শুভেন্দুর জয় এবং বিরোধী দলনেতা হিসাবে তাঁর ভূমিকা শুভেন্দুকে ‘অন্য উচ্চতা দিয়েছে’ বলে বিজেপির ওই প্রাক্তন রাজ্য সাধারণ সম্পাদকের দাবি। তাঁর কথায়, ‘‘নিষ্ফলা দলবাজির বদলে অনেকে একটা গঠনমূলক ভবিষ্যতের কথাও শুনতে চান। সে স্বপ্ন এ বার আমাদের রাজ্য সভাপতি দেখাচ্ছেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement