উত্তরবঙ্গে বাজের ঘায়ে মৃত্যু ৮ জনের

বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর কেটে রাখা বোরো ধান বাঁচাতে কেউ জমির আল কেটে জল বের করতে ছুটেছিলেন মাঠে, কেউ আবার ঝরে পড়া আম কুড়োতে। সে সময় বাজ পড়ে তিন জেলায় মোট আট জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আরও কয়েক জন। এর মধ্যে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মালদহের চাঁচল মহকুমা। সেখানে বজ্রপাতে প্রাণ গিয়েছে পাঁচ জনের।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৬ ০৩:০০
Share:

দিনহাটায় দুই শিশুর দেহ। —নিজস্ব চিত্র।

বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর কেটে রাখা বোরো ধান বাঁচাতে কেউ জমির আল কেটে জল বের করতে ছুটেছিলেন মাঠে, কেউ আবার ঝরে পড়া আম কুড়োতে। সে সময় বাজ পড়ে তিন জেলায় মোট আট জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আরও কয়েক জন। এর মধ্যে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মালদহের চাঁচল মহকুমা। সেখানে বজ্রপাতে প্রাণ গিয়েছে পাঁচ জনের।

Advertisement

চাঁচলের এসডিপিও রানা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দুঃখজনক ঘটনা। দেহ ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে। ক্ষতিপূরণের বিষয়টি প্রশাসন দেখছে।’’ চাঁচলের মহকুমাশাসক পুষ্পক রায় বলেন, ‘‘বাজে মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। মৃতরা যাতে দ্রুত সরকারি ক্ষতিপূরণ পায় তা দেখা হবে।’’ পুলিশ ও গ্রাম পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃতদের নাম পার্বতী বিন (৮), জসিমুদ্দিন আহমেদ (১৪), বিশারত আলি (২৫), মহম্মদ সাহাবুদ্দিন (৪৫) ও তফোজ্জল হক (৫৫)।

মাঠে কাজ করার সময় বাজ পড়ে আহত হয়েছেন একই পরিবারের তিন জন-সহ মোট সাত জন। তাঁদের মধ্যে পাঁচ জন মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, ইংরেজবাজার থানার ফুলবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের বিনপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মহাবীর চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী শকুন্তলাদেবী ও তাঁদের একটি দু’বছরের নাতি আহত হয়েছে। মহাবীরবাবু শ্রমিকের কাজ করেন। বজ্রপাতে আহত মহাবীরবাবুর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, আম বাগানে কাজ করছিলেন তিনি। এ দিন সকালে মেঘ দেখে নাতিকে নিয়ে মহাবীরবাবুকে খুঁজতে বাগানে গিয়েছিলেন শকুন্তলাদেবী। তখন বজ্রপাত হলে তিন জনই আহত হন। পরে পরিবারের লোকেরা উদ্ধার করে তাদের মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। বাজ পড়ে আহত হয়েছে গাজলের গাজিপুর গ্রামের বিজন সোরেন এবং চাঁচলের সুজন মহালদার। তাঁরাও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

Advertisement

এ দিন সকাল থেকেই চাঁচল মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টি শুরু হয়। কয়েকটি এলাকায় বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হয় প্রবল বজ্রপাত। এখন বোরো ধান ওঠার মুখে। ধান কেটে অনেক চাষিই তা মাঠে রেখেছিলেন। জমিতে জল জমে যাতে ধান নষ্ট না হয়ে যায়, সে জন্য চাষিরা জমিতে ছুটে যান। বৃষ্টির মধ্যে মাঠের ধান এক জায়গায় জড়ো করছিলেন হরিশ্চন্দ্রপুরের ভালুকা গ্রাম প়ঞ্চায়েতের জগন্নাথপুরের বিশারত আলি। পাশের জমিতে কাজ করছিলেন আরও পাঁচ জন। ওই সময় বাজ পড়লে শরীর ঝলসে যায় বিশারত ও হজরত আলি নামে আর এক জনের। বিশারত ঘটনাস্থলেই মারা যান। আশঙ্কাজনক অবস্থায় মশালদহ হাসপাতালে চিকিত্সা চলছে হজরত আলির। সিভিক ভল্যান্টিয়ার হজরত জমিতে কাজ করছিলেন।

ওই পঞ্চায়েত এলাকার হাতিছাপা গ্রামে বৃষ্টির মধ্যে আম কুড়োতে গিয়ে বাজ পড়ে মারা যায় পার্বতী বিন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। ধানের জমিতে আল কেটে জল বের করার সময় বাজ পড়লে ঝলসানো শরীর নিয়ে মাঠেই অচেতন হয়ে পড়েছিলেন হরিশ্চন্দ্রপুরের সোনাকুলের মহম্মদ সাহাবুদ্দিন। পাশের মাঠ থেকে চাষিরা ছুটে এসে তাঁকে হরিশ্চন্দ্রপুর হাসপাতালে নিয়ে যেতে চান। তখন পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। একই ভাবে জমির আল কাটতে মাঠে ছুটেছিল রতুয়া-২ ব্লকের কুমারগ়ঞ্জের বছর চোদ্দোর জসিমুদ্দিন। বাজ পড়ে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। বোরো ধানের জমিতে কাজ করার সময় একই ভাবে মৃত্যু হয় চাঁচলের খানপুরের তফোজ্জল হকের।

দক্ষিণ দিনাজপুরে বালুরঘাট থানার নজিরপুর এলাকাতেও বাজ পড়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে সকাল ১০টা, নাগাদ নজিরপুর অঞ্চলের যশাহারতে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতের নাম মলয় মণ্ডল (৪৫)। বৃষ্টি নামলে মাঠে বাঁধা গরুকে আনতে গিয়েছিলেন মলয়বাবু ও তাঁর ভাই পিন্টু। গরু নিয়ে ফেরার পথে বিকট শব্দ করে বাজ পড়ে। পিন্টু বলেন, ‘‘পিছনে ফিরে দেখি দাদা মাঠে লুটিয়ে পড়েছেন।’’ বালুরঘাট হাসপাতালে নিয়ে এলে তাঁকে মৃত বলে জানানো হয়।

কোচবিহারে বাজ পড়ে মৃত্যু হল সপ্তম শ্রেণির দুই ছাত্রের। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটে দিনহাটার গোবড়াছড়া-নয়ারহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের খারিজা দশগ্রাম গ্রামে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই দুই ছাত্রের নাম সুমন দাস (১২) এবং খোকন দাস (১৩)। ওই ঘটনায় ছোটন দাস নামে আর এক জনকে কোচবিহার জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। কোচবিহারের মহকুমাশাসক কৃষ্ণাভ ঘোষ বলেন, “বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রশাসনের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” নয়ারহাটের বাসিন্দা জেলা পরিষদের সদস্য মমতাজ বেগম ঘটনাস্থলে যান।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই তিন জন খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একই ক্লাসে পড়ে এবং একই সঙ্গে খেলাধুলাও করে। এ দিনও তারা খেলছিল। বেলা ১২টা নাগাদ আচমকা ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। ওরা বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার সময় পায়নি। মাথা বাঁচাতে মাঠের কাছে একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে পড়ে। হঠাৎই বাজ পড়ে সেখানে। ঘটনাস্থলেই সুমন ও খোকনের মৃত্যু হয়। ছোটনকে গ্রামের বাসিন্দারা জখম অবস্থায় দিনহাটা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে রেফার করা হয় কোচবিহার জেলা হাসপাতালে। বাসিন্দাদের অনেকেই বলেন, “বৃষ্টি পড়ছে বলে তারা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে মাথা বাঁচাতে চেয়েছিল ওরা। কিন্তু গাছ আর ওদের বাঁচাতে পারল না।”

এ বছর বৈশাখ মাস পড়তেই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই যে কোনও সময় ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে কোনও না কোনও জায়গায়। শিলাবৃষ্টিও হচ্ছে। তাতে ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ছেন বাসিন্দারা।

প্রশাসন সূত্রের খবর, প্রায় প্রতি বছর বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা জানান, চাষের জন্য গ্রামের মানুষ বেশির ভাগ মাঠে থাকেন। সে কারণে বাজ পড়ে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা গ্রামের দিকেই বেশি। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রামীণ কৃষি মৌসম বিভাগের নোডাল অফিসার শুভেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ঝড়বৃষ্টির সময় বাসিন্দাদের বাইরে বা খোলা মাঠে না থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এমন সময় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা দেখলে মানুষকে সাবধান থাকতে হবে। তেমনটা হলে ঘরের নিচে আশ্রয় নেওয়া ভাল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন