দিনভর বুথে বুথে টহল অশোকের

কয়েক বছর আগেও বিধানসভা ভোটের প্রার্থী হিসাবে তিনি শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে একদফা ঘুরেই দিনভর কাটিয়ে দিতেন দলের দফতরে। এরপর চলত টেলিফোন, মোবাইলে খোঁজখবর নেওয়ার পালা। খোঁজ নিতেন রাজ্যের নানা প্রান্তেরও। ফোনেই কর্মীদের নানা নির্দেশ দিতেন। তিনি যে রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। শনিবার পুরভোটের দিন তাঁকে কিন্তু সাত সকাল থেকে বিকাল অবধি অন্যরকম ভাবেই দেখলেন শিলিগুড়ির বাসিন্দারা।

Advertisement

কৌশিক চৌধুরী

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৩৮
Share:

কয়েক বছর আগেও বিধানসভা ভোটের প্রার্থী হিসাবে তিনি শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে একদফা ঘুরেই দিনভর কাটিয়ে দিতেন দলের দফতরে। এরপর চলত টেলিফোন, মোবাইলে খোঁজখবর নেওয়ার পালা। খোঁজ নিতেন রাজ্যের নানা প্রান্তেরও। ফোনেই কর্মীদের নানা নির্দেশ দিতেন। তিনি যে রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য।

Advertisement

শনিবার পুরভোটের দিন তাঁকে কিন্তু সাত সকাল থেকে বিকাল অবধি অন্যরকম ভাবেই দেখলেন শিলিগুড়ির বাসিন্দারা।

পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে অশোকবাবু এবার সিপিএম প্রার্থী। সকাল থেকে অন্তত পাঁচশো মিটার দূরে থাকা মাত্র দু’টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের ছয়টি বুথ ‘আগলে’ রাখার জন্য বহুবার হেঁটে ফেললেন এ মাথা থেকে আরেক মাথা। আবার কোনও সময় দলের ছাত্র নেতার বাইকে চড়েই ঘুরলেন এলাকায়। নিজেদের কর্মী তো বটেই, বিরোধীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলা, শাসক দলের দফতরে এক দফায় বসে পড়েও সৌজন্য বিনিময় করলেন। লাল প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে থাকলেন রাস্তার মোড়ে। বারবার মোবাইলে এক একটি বুথের খোঁজখবর নিতে থাকলেন।

Advertisement

শুধু তাই নয়, ভোটগ্রহণের আট ঘন্টার মধ্যে অন্তত ছয় ঘন্টা বুথের কাছাকাছিই ছিলেন। যা দেখে দলীয় কর্মীরা তো বটেই বিরোধীদের অনেকেই জানালেন, অশোকবাবু সকাল থেকেই পুরো এলাকার ‘কন্ট্রোল’ নেওয়ার কাজ করে গিয়েছেন। চেষ্টা করেছেন, যাতে কোনও ভাবেই গোলমাল না হয়। প্ররোচনা দেখা দিলেই সবার আগে সেখানে গিয়ে তা প্রশমিত করার চেষ্টাও করেছেন।

বেলা তিনটের কিছুক্ষণ পর এলাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে কর্মীদের বুথ এলাকা না ছাড়ার পরামর্শ দিয়ে অশোকবাবু জানিয়ে গেলেন, ইভিএম না বার হওয়া অবধি কেউ যাবে না। তিনি বলেন, ‘‘আমাকে সব জানাতে থাকুন। প্রয়োজনে আমি ফের চলে আসব।’’ এর পরে হিলকার্ট রোডের পার্টি অফিসে গিয়ে রুটি-তরকারি খেয়ে উঠে বললেন, ‘‘প্রয়োজনে কর্মীরা স্ট্রংরুম অবধি ভোট কর্মীদের পিছনে যাবেন। বহিরাগত আমদানি, তৃণমূলের সন্ত্রাস, বুথজ্যামের সম্ভবনা সবই ছিল। তাই প্রতিটি বুথ আগলে রাখার কাজটা করতে হয়েছে। কর্মীদের নিয়ে মানুষকে ভোট দেওয়ার অধিকারকে রক্ষা করেছি। ফলাফল কী হয়, দেখা যাক।’’

সকালে বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় দিয়ে সাতটা নাগাদ মুড়ি-ছানা খেয়ে সোজা চলে যান বাড়ির পাশের নেতাজি স্কুলের নিজের বুথে। এলাকা নিয়ে তিনি সকাল থেকে এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে, তড়িঘড়ি ভোট দিয়ে চলে আসলেন ছয় নম্বর ওয়ার্ডে। তা দেখে অনেকেই বললেন, ‘‘আগে অশোকবাবু ভোট দিয়ে গল্পগুজব করতেন। তার পরে যেতেন। এবার দেখলাম, একটু ব্যস্তই। বৃষ্টিতে ভোট কেমন হবে, তা নিয়ে হয়ত চিন্তিতও ছিলেন।’’

লালচে পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা আর পায়ে খয়েরি বেল্টের চটি, দিনভর এই পোশাকেই চলল অশোকবাবুর চড়কিপাক। কোথায় কে আছেন, কোন রাস্তা, গলি-মহল্লার কী অবস্থা স্থানীয় কর্মীদের থেকে শোনা ছাড়াও ঢুকে পড়লেন বুথে বুথে। ওয়ার্ডে শাসক তৃণমূল ছাড়াও কংগ্রেস, বিজেপি এবং একজন নির্দল প্রার্থীর লোকজন কী করছেন, তাতে কড়া নজর রাখা শুরু করলেন। তৃণমূলের তরফে বারবার দাবিও করা হচ্ছিল, অশোকবাবুর নেতৃত্বে এলাকায় রামধনু জোট হয়ে গিয়েছে। এক সময় তৃণমূল প্রার্থী অরূপরতন ঘোষ তো বলেই ফেললেন, ‘‘সিপিএমের নেতৃত্বে এলাকায় লোকজন ঢুকেছে। আমি পুলিশকে টেলিফোন করে অভিযোগ করলাম। দলবেঁধে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চলেছে দিনভর।’’

দুপুরে এলাকায় আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন হলেও ভোটের লাইনে বা বাইরে ভিড় দেখলেই সেখানে এগিয়ে যাওয়া, এমনকি, ভোটার স্লিপ দেখে বুথ চিহ্নিত করতেও দেখা যায় অশোকবাবুকে। বেলা বাড়তেই দলের নেতা, কর্মীদের অনেকের চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ দেখা গেলেও তিনি দুই দফায় লাল চা এবং বিস্কুট খেয়ে ঘুরতে থাকেন। হাসতে হাসতে ভোটারদের নমস্কার করা তো বটেই, ভোট দিতে বার হওয়ার পরেও তিনি সবার সঙ্গে হাত মেলাতে থাকেন। কোনও কোনও প্রার্থীকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে, অভিযোগ জানাতে যেমন দেখা গিয়েছে, তেমনই অনেককে পুলিশ এলাকা থেকে সরে যেতেও বলেছে। কিন্তু অশোকবাবুকে সরাসরি কিছুই বলেনি। তবে তাঁরা সিপিএম কর্মীদের নানা নির্দেশ দিয়েছেন।

বিকালে স্থানীয় এক কংগ্রেস নেতা বললেন, ‘‘অশোকবাবুর দিনভর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ যা ছিল, তাতে তো ওঁকেই শাসক দলের প্রার্থী মনে হচ্ছিল। বাকিরা এ ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছনে।’’ সোয়া তিনটায় একেবারে গাড়িতে ওঠার আগে ছয়টি বুথের কিছু হিসাব নিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী বললেন, ‘‘ওয়ার্ডে ৮০ শতাংশের উপর ভোট হল। বৃষ্টিটা না হলে আরেকটু হত। তিন জন মাত্র সময়ের পর এসেছেন। আশা করছি, সারা দিনে কর্মীদের খাটাখাটনি ভাল ফল দেবে।’’

সেই সময় অবশ্য বুথ ছেড়ে তৃণমূল, কংগ্রেস এবং নির্দল প্রার্থীদের কর্মীদের বিরিয়ানি খাওয়ার ‘হুড়োহুড়ি’ শুরু হয়ে গিয়েছে। অশোকবাবুদের নির্দেশে সিপিএমের কর্মীদেরও বিরিয়ানি এল। তবে তা ভোটপর্ব প্রায় মিটে যাওয়ার পরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন