আজব শিঙাড়া
দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম তখন অটলবিহারী বাজপেয়ী। রাজ্যের ক্ষমতার কেন্দ্র তখন লালদিঘির পাড়ের লালবাড়ি, যার সরকারি নাম মহাকরণ। সেই বাড়িতেই বসতেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। জলপাইগুড়ির কান্তেশ্বরী দিঘির উল্টো দিকে দরমা বেড়ার ছাউনি তৈরি করে শিঙ্গাড়া ভাজতে শুরু করেন এলাকারই রায় দম্পতি। শিঙ্গাড়ার দাম ঠিক হয় ১ টাকা। তারপর পৃথিবী অনন্ত ১৮ বার সূর্যের চারদিকে পাক খেয়ে ফেলেছে। অটলবিহারী-র স্থানে এখন নরেন্দ্র মোদী আর বাংলার ক্ষমতার ভরকেন্দ্র লালদিঘি-লালবাড়ি থেকে সরে গঙ্গা পাড়ে নবান্নতে। দ্বিতীয় বারের জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এতকিছু বদলে গিয়েছে, শুধু বদলায়নি কান্তেশ্বরী দিঘি পাশের শিঙ্গাড়ারা দাম। এখনও ১ টাকার শিঙ্গাড়ার জন্য ভিড় হয় দোকানে। সেই শহরেই আরেক প্রান্তে ৪০ টাকা দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ার ভিড়ে মাঝেমধ্যে যানজটও হয়ে যায়।
দোকানে। সেই শহরেই আরেক প্রান্তে ৪০ টাকা দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ার ভিড়ে মাঝেমধ্যে যানজটও হয়ে যায়। এই বাজার মন্দা, মূল্যবৃদ্ধির বাজারেও এই দুটি দোকানকে যেন ছুঁতে পারেনি মূল্যবৃদ্ধির আগুনে আঁচ।
আজব বিরিয়ানি
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন শিঙ্গাড়ার স্বাদ বোঝার ফর্মুলা। সেই তত্ব অনুযায়ী প্রথমে গরম শিঙাড়া টুকরো করে মুখে ফেলতে হবে। মুখ হা করে শিঙাড়ার টুকরো ঠান্ডা করতে হবে। তারপরে বসাতে হবে কামড়। এতেই নাকি শিঙাড়ার স্বাদ সার্থক হয়। জলপাইগুড়ির বাচ্চু রায় জানালেন, ভাল শিঙ্গাড়ার প্রথম শর্ত হল ভাল আলু। নিজে বাজার থেকে কিনে আনেন। বাচ্চুবাবুর স্ত্রী মানুদেবী জানালেন, “দিনে চারশো শিঙ্গাড়া করি, তাতেই লাভ হয়। না হলে আজকের বাজারে কেউ এক টাকায় শিঙ্গাড়া খাওয়াতে পারে।” অর্থনীতির নীতিই অন্যভাবে শোনা গেল আটপৌড়ে গৃহীনির কথায়। বাচ্চুবাবু হিসেব কষে জানালেন এক একটি শিঙ্গাড়া তৈরি করতে তাঁদের ৭৫ পয়সা খরচ হয়। প্রয়োজন হয় ২ কেজি ময়দা এবং ২ কেজি আলুর। আলু এবং ময়দা বাবদ প্রায় একশো টাকা খরচ। তার শঙ্গে রয়েছে ১ কেজি তেল এবং অন্যান্য অনাজের খরচ। সব মিলিয়ে চারশো শিঙ্গাড়া বিক্রি করে দিনে আড়াইশো টাকা লাভ ঢোকে দম্পতির ঘরে। আকারে তুলনায় অনেকটাই কম। তবে ভিতরের সজ্জায় কোনও ক্রুটি নেই। উপরি পাওনা শিঙ্গাড়ার গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া সস এবং পেঁয়াজ কুঁচি।
জলপাইগুড়ির অনেকে দাবি করেন বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য নাকি এই শহরেই। পকেটে ৪০ টাকা থাকলেই খোশবাই বিরিয়ানি খাওয়া যেতে পারে। একটা ঠেলাভ্যানে শহরের থানামোড়ের সামনে বিরিয়ানি বিক্রি করেন মুস্তাফার রহমান। তবে সেই নামে তাঁকে কতজনই বা চেনে! সবাই তাঁকে চেনে আলি নামে।
জলপাইগুড়ি শহরের সব প্রান্তের লোক আলি শুনলেই বিরিয়ানির কথা ভাবেন। সে কথা জেনে ঠেলার গায়ে বড় করে পোস্টারও লাগিয়েছেন স্রষ্টা নিজেই। আলি বিরিয়ানি। চিকেন হোক বা মটন বিকেল থেকে শহরের ফুটপাতে বিরিয়ানির ঢালাও আয়োজন। এত কম দামে বিরিয়ানির গুণগত মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন অনেকে। কেউ বা ঠাট্টা করেন। সে সব শুনে ফোঁস করে ওঠেন আলি। দাবি করলেন, ৯৬ টাকা কেজি বাসমতি চাল কেনেন।
কলকাতা থেকে আসে তাঁর যাবতীয় বিরিয়ানির মসলা। তবে এত সস্তায় কী করে? আলি বলেন, “আমি নিজেই রান্না করি, নিজেই জোগাড় করি। বাড়ির সকলে মিলে কাজ করে তাই অনেক টাকা বেঁচে যায়। শুধু ভিড়ে পরিবেশন করতে দু জন ছেলে রেখেছি। নিজে স্টেশন বাজার থেকে মাংস কিনে আনি। গুণগত মানে কোনও আপস হয় না। তাহলে পনেরো বছর ধরে এই দোকান চালাতে পারতাম না।”
আলু এবং ডিম অবশ্য এই বিরিয়ানিতে মিলবে না। ডিমের জন্য অতিরিক্ত ১০ টাকা দিতে হবে। প্রতিদিন ২০০ প্লেট বিরিয়ানি বিক্রি হয়। প্রতি প্লেটে ৫ টাকা লাভ বলে দাবি করলেন। সঙ্গে চিলিচিকেন, মটন কষা ইত্যাদি রয়েছে। সেগুলির দাম অবশ্য কম নয়। আলির কথায়, “বিরিয়ানির লাভ অন্যান্য পদে উসুল হয়ে যায়।”
তাই সব জিনিসের দাম বাড়ছে বলে তামাম দেশবাসী যখন নাজেহাল, তখন জলপাইগুড়ির এই দুই দোকান যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। আর সেটাই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন জলপাইগুড়ির বাসিন্দারা।