গত শনিবারের শিলাবৃষ্টি। এতেই আশঙ্কা ক্ষতির। —ফাইল চিত্র।
কোথাও ঝড়ে উপড়ে পড়েছে একের পর এক চা বাগানের শেড ট্রি, কোথাও বা এক থেকে দুই ইঞ্চি মাপের শিল পড়ে প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে বাগানের নার্সারি। আবার বহু বাগানে ক্ষতি হয়েছে পাতার। বাদ যায়নি বাগানের শ্রমিক বস্তি থেকে শুরু করে অফিসারদের বাংলোও। ঝড়-বৃষ্টিতে কোথাও বাড়ির টিন উড়ে গিয়েছে। বহু এলাকায় তার ছিঁড়ে পড়ে বিদ্যুৎ পরিষেবাও বিপর্যস্ত হয়। গত শনিবার রাতে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রায় আধঘন্টার ঝড় ও ব্যাপক শিলাবৃষ্টিতে এমনই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে চা বাগিচাগুলির। চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংগঠনের হিসাবে অনুসারে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়ে গিয়েছে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা।
ইতিমধ্যে চা বাগান মালিকদের সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে চা পষর্দের কাছে পুরো বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। মার্চ মাস থেকেই বাগানে ভরা মরশুম শুরু হয়ে গিয়েছে। চলবে পুজোর সময় অর্থাৎ অক্টোবর পর্যন্ত। এই সময়েই বাগানের নতুন পাতা তোলা, কারখানায় বিভিন্ন ধরণের চা উৎপাদন পুরোদমে চলে। সেখানে মরশুমের শুরুতেই উত্তরবঙ্গে চা শিল্প একটা সংকটের মুখে পড়ল বলে শিল্প মহল মনে করছে।
রাজ্যের চা বাগান মালিকদের বিভিন্ন সংগঠনের যৌথমঞ্চ কনসালটেটিভ কমিটি অব প্ল্যান্টেশন অ্যাসোসিয়েশনস-এর (সিসিপিএ) সেক্রেটারি জেনারেল মনোজিৎ দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘মরশুমের শুরুতেই উত্তরবঙ্গের বাগানগুলি বড় একটা ধাক্কা খেল। এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাগানগুলিকেই বহন করতে হবে। উৎপাদনে এর প্রভাব তো পড়বেই।’’
সিসিপিএ সূত্রের খবর, মূলত চা বাগিচাগুলিতে তৈরি চা বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়া, গুদামে রাখার মত ক্ষেত্রেই বিমা করানো থাকে। বাগানের সাধারণত কোনও বিমা থাকে না। শিলাবৃষ্টির ক্ষেত্রে বিমা করানোর ব্যবস্থা থাকলেও তা অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ হওযায় বাগান কর্তৃপক্ষ সাধারণত সেই পথে হাঁটেন না। ছোট বড় মিলিয়ে প্রতিটি বাগানে ২ থেকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়েছে। টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার ডুয়ার্সের সেক্রেটারি সুমিত দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছে। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সেই বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আর ১-২ মাস লাগবে। বিশেষ করে গাছের এবং নার্সারির বেশি হয়েছে। অনেক জায়গায় গাছ তুলে নতুন গাছ লাগাতে হবে।’’
আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, শনিবার সিকিম এবং উত্তরবঙ্গের সমতল এলাকায় নিম্নচাপ অক্ষরেখার অবস্থানের কারণে ঝড় বৃষ্টি হয়। সঙ্গে নিম্নচাপের কারণে প্রবল শিলাবৃষ্টি হয়। ফালাকাটা, বীরপাড়া, বানারহাট, মেটেলি, কুমারগ্রাম এলাকায় বেশি ক্ষতি হয়। রানিচেরা, গুডহোপ, মালনদী, তোর্সা, দলমোড়, দলগাঁও, গয়েরকাটা, মেচিপাড়া, ইটি হেলবাড়ি, গ্রাসমোড়, সুকনা, ইনডং, জুরান্তির বাগানগুলিতেও ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। গাছ পড়ে গয়েরকাটা-তেলিপাড়ার মধ্যে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাত পর্যন্ত জাতীয় সড়ক অবরূদ্ধ ছিল। গাছ উপড়ে ক্ষতি হয়েছে বানারহাট চা বাগানেও।
ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের বীরপাড়া ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান রজত দে বলেন, ‘‘নতুন এবং পুরানো সব বাগানের ক্ষতি তো হয়েইছে, বাদ পড়েনি শ্রমিক আবাস, ও অফিসারদের বাংলোগুলিও। কমবেশি সব বাগানেরই একই দশা। এই সময় উৎপাদন চালু রেখে অবস্থা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টাই চলছে।’’
উত্তরবঙ্গে ছোটবড় মিলিয়ে ৩০০ উপর চা বাগান রয়েছে। এরমধ্যে পাহাড়ে ৭৮টি এবং তরাই-এ ৪৮টি-র মত বাগান রয়েছে। বাকি সব বাগানই ডুয়ার্সে। বিভিন্ন বাগান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ছোট বাগানগুলিতে কমপক্ষে এক লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বড় বাগানগুলিতে এই ক্ষতির পরিমাণ ৫ লক্ষের মত। সবচেয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে বাগানগুলির নার্সারি নিয়ে। কারণ, এই সময়ই নার্সারির গাছগুলি ঠিকঠাক করে বাগানের বিভিন্ন শাখায় প্রয়োজন মত লাগানো হয়। কিন্তু ছোটগাছগুলি শিলা বৃষ্টিতে গুড়িয়ে গিয়েছে। সেগুলির জায়গায় নতুন চারা তৈরি করে ফের বসানোটা সময় সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াবে। সেই সঙ্গে বহু শেডট্রি ভেঙে পড়ায় রোদের তেজেও বাগানের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।