গঙ্গায় হুঁশিয়ারি। নিজস্ব চিত্র।
নীহার বিশ্বাসতীরে কী প্রচণ্ড কলরব, জলে ভেসে যায় কার শব...।
চন্দ্রযান চাঁদে গেল। উপগ্রহরা কক্ষপথে। অত্যাধুনিক ফাইটার জেট এল। কিন্তু অতিমারিতে মৃতের দেহ নদী বেয়ে আসার ছবিটা বদলাল কোথায়? একশো বছর আগে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে যা লিখেছেন, তার আরও কয়েক দশক আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘আনন্দমঠ’-এ যে কথা বলেছেন, বাস্তবে সেই দৃশ্যই ফিরে আসছে। মালদহের মানিকচকের কাছে গঙ্গা ঝাড়খণ্ড পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে ঢুকছে। আপাতত সেখানেই চলছে অপেক্ষা, দেহ ভেসে আসার।
এ বড় সুখের সময় নয়। এমন অপেক্ষায় মৃতদেহ পচনে ঘ্রাণ বাতাসকে ভারী করে। যেমন, ধরা যাক শ্রীকান্ত উপন্যাসে— ‘কিছুক্ষণ হইতে কেমন একটা দুর্গন্ধ মাঝে মাঝে হাওয়ার সঙ্গে নাকে আসিয়া লাগিতেছিল। যত অগ্রসর হইতেছিলাম, ততই সেটা বাড়িতেছিল। এখন হঠাৎ একটা দমকা বাতাসের সঙ্গে সেই দুর্গন্ধটা এমন বিকট হইয়া নাকে লাগিল যে, অসহ্য বোধ হইল। নাকে কাপড় চাপা দিয়া বলিলাম, নিশ্চয় কি পচেছে, ইন্দ্র! ইন্দ্র বলিল, মড়া। আজকাল ভয়ানক কলেরা হচ্ছে কিনা। সবই তো পোড়াতে পারে না— মুখে একটুখানি আগুন ছুঁইয়ে ফেলে দিয়ে যায়। শিয়াল-কুকুরে খায় আর পচে। তারই গন্ধ..।’
গ্রামকে গ্রাম দুর্ভিক্ষে উজার হয়ে যাওয়ার গল্প শুনিয়েছিলেন বঙ্কিমও। আনন্দমঠ উপন্যাসে পদচিহ্ন গ্রামে বসন্ত রোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ
কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না; মরিলে কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে..।’
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার তাঁর ‘আরণ্যক’ গ্রন্থে আর এক গল্প শুনিয়েছেন— ‘সেবার শুয়োরমারি বস্তিতে ভয়ানক কলেরা আরম্ভ হইল, কাছারিতে বসিয়া খবর পাইলাম। শুয়োরমারি আমাদের এলাকার মধ্যে নয়, এখান থেকে আট-দশ ক্রোশ দূরে, কুশী ও কলবলিয়া নদীর ধারে। প্রতিদিন এত লোক মরিতে লাগিল যে, কুশী নদীর জলে সর্বদা মড়া ভাসিয়া যাইতেছে, দাহ করিবার ব্যবস্থা নাই..।’
দেশ তো বটেই, এই বাংলাও যুগে যুগে এমন সব ছবি দেখেছে। সাহিত্যের বর্ণনা সেই জীবন থেকেই উঠে এসেছে। তার পরে এতগুলি বছর কেটেছে, বিজ্ঞানে এত উন্নতি, তবু মালদহে গঙ্গার তীরে এক ডজন নৌকা আর হাফ ডজন ডোমকে অপেক্ষা করতে হয় ভেসে আসা মৃতদেহের।
তা-ও ধন্য আশা কুহকিনী। কারণ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তো সেই কবে লিখেছিলেন, ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি, বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশীষে অমৃতের টিকা পরি।’ তখন বিধির আশীষই ছিল অমৃতের টিকা। এখন টিকা থাকলেও পরিকল্পনাহীনতায় তা অব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। শোনা যায়, বসন্ত হয়েছে দেখে লালুকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের
কলিঙ্গ নদীতে। সে-ই পরে বরাত জোরে বেঁচে লালন ফকির হয়ে ওঠে। কিন্তু ‘ফকিরের’ দেশে এমন কপাল ক’জনের? না থাকলে কপালে করাঘাত করা ছাড়া উপায়ই বা কোথায়?