Cooch Behar

গাঁজা কারবারে টেনে আনার ‘টোপ’ দাদন

সেখানে বিঘার পরে বিঘা জমিতে শুধু গাঁজা গাছ। সাধারণ কেউ বাইরে থেকে গেলে, যাতে চট করে গাঁজা গাছ দেখতে না পায়, সে জন্য পাটকাঠির বেড়া দিয়ে জমি ঘিরে রাখা হয়।

Advertisement

নমিতেশ ঘোষ, অরিন্দম সাহা

কোচবিহার শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৭:৪০
Share:

গাঁজা খেত নষ্ট করতে পুলিশ ও আবগারি দফতরের অভিযান কোচবিহারে। ফাইল চিত্র

কোচবিহারে কান পাতলেই শোনা যায় গাঁজা কারবারের গল্প। শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়, কুড়ি থেকে পঁচিশ কিলোমিটারের মধ্যেই গাঁজা চাষের ‘রমরমা’ বলে অভিযোগ। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া বেশ কিছু এলাকা কার্যত মাদক কারবারিদের কাছে ‘স্বর্গরাজ্য’ বলেও শোনা যায়।

Advertisement

সেখানে বিঘার পরে বিঘা জমিতে শুধু গাঁজা গাছ। সাধারণ কেউ বাইরে থেকে গেলে, যাতে চট করে গাঁজা গাছ দেখতে না পায়, সে জন্য পাটকাঠির বেড়া দিয়ে জমি ঘিরে রাখা হয়। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনের জানার কথা কোথায়, কোন এলাকায় ঠিক কতটা গাঁজা চাষ হচ্ছে! তা হলে সে ছবি বদলায় না কেন? তা কার্যত ‘রহস্য’ কোচবিহার জেলাবাসীর কাছে।

পুলিশ ও আবগারি দফতর অবশ্য দাবি করেছে, ফি বছর গাঁজা গাছ নষ্ট করতে অভিযান চালায় তারা। হাজার হাজার বিঘা জমির গাঁজা গাছ কেটে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কোচবিহারের পুলিশ সুপার সুমিত কুমার বলেন, ‘‘গাঁজা চাষ বন্ধে ধারাবাহিক অভিযান চালানো হয়। বহু গাঁজা নষ্ট করার পাশাপাশি একাধিক গ্রেফতারও করা হয়েছে। এই অভিযান ধারাবাহিক ভাবে চলবে।’’ আবগারি দফতরের কোচবিহার জেলা আধিকারিক একলব্য চক্রবর্তী দাবি করেন, ধারাবাহিক অভিযানে ওই চাষ অনেকটাই কমিয়ে আনতে পেরেছেন তারা। তাঁর দাবি, ‘‘জেলায় ধীরে ধীরে পুরোপুরি ওই গাঁজার চাষ বন্ধ করতে সমর্থ হব আমরা।’’ কিন্তু কেন গাঁজা চাষের প্ৰতি আকৃষ্ট একটি অংশ। এর পিছনে মদত রয়েছে কাদের?

Advertisement

পুলিশ ও আবগারি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কোচবিহার সদরের মাঘপালা, পুন্ডিবাড়ি, মাথাভাঙার ঘোকসাডাঙা, শীতলখুচি, মেখলিগঞ্জ, তুফানগঞ্জ ও দিনহাটার বামনহাট, চৌধুরীহাট, ধাপড়া-সহ বেশ কিছু এলাকায় গাঁজা চাষ হয়। চাষিদের অতিরিক্ত টাকার লোভ দেখিয়ে ওই চাষে নামানো হয় বলে অভিযোগ। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, গাঁজা চাষে এখনও চলছে ‘দাদন’ প্রথা। বিঘা প্ৰতি জমিতে চাষিকে আগাম দু’লক্ষ টাকা করে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। আর এর পিছনে রয়েছে একটি বড় চক্র। তার মধ্যে রয়েছে ভিন‌্-রাজ্যের গাঁজা পাচারকারীরা। দিল্লি, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ থেকে গাঁজা কারবারিদের সঙ্গে কোচবিহারের একাধিক গ্রামের যোগ রয়েছে। গাঁজা গাছ পরিণত হলে, সেগুলি নিয়ে যায় তারা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে টাকার টোপে পড়ে গ্রামের যুবকদের একটি অংশ গাঁজা পাচারের কাজে নামে। এমন অনেকেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। কারও কারও জেলও হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গাঁজা চাষির দাবি, ‘‘এক বিঘা জমিতে ধান বা আলু করে বিঘা প্ৰতি খুব বেশি হলে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হবে। এক বিঘা জমিতে গাঁজা চাষ করলে সেখানে কম পক্ষে পাঁচ লক্ষ টাকা আয় হবে।’’ শুধু টাকার লোভেই তা হলে আইন ভাঙেন? জবাব দেননি ওই চাষি। বাজারে সে গাঁজার প্রতি ১০ গ্রামের ‘পুরিয়া’ ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিকোয় বলে আবগারি দফতর সূত্রের খবর।

২০১৬ সালের মাঝামাঝি পুলিশ ও আবগারি দফতরের অধিকারিকেরা শীতলখুচির ভোগডাবরি গ্রামে অভিযানে গিয়েছিলেন। অভিযোগ, সে সময় গোটা সরকারি দলকে ঘিরে ধরে হামলা চালায় গাঁজার কারবারিরা। গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। কয়েক জন পুলিশ ও আবগারি কর্মী জখমও হন। পরে, বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় ছশো কুইন্টাল গাঁজা বাজেয়াপ্ত করা হয়। কোচবিহারে কান পাতলে শোনা যায়, কিছু কিছু গ্রামে গাঁজা কারবারিরা এতটাই জোটবদ্ধ, সেখানে পুলিশও ঢুকতে ভয় পায়। পুলিশ অবশ্য তা মানতে চায় না। কিন্তু মাদকের কারবারিদের এত সাহস হয় কী করে? কোচবিহার দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক নিখিলরঞ্জন দে-র অভিযোগ, ওই চক্রের সঙ্গে যোগ রয়েছে তৃণমূলের নেতাদের। তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান গিরীন্দ্রনাথ বর্মণ অবশ্য দাবি করেন, ‘‘দল কোনও ভাবেই মাদকের কারবারের সঙ্গে জড়িত নয়। আমাদের আমলেই বরং মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।’’

তা-ই কি? ভোগডাবাড়ি গ্রামের একাধিক গাঁজা চাষি হেসে বলেন, ‘‘দল বদলায়। মাথার উপরের হাত বদলায়। চলে গাঁজা চাষ।’’ (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন