রাস্তা-ঘাট সব একাকার বন্যার জলে। কোচবিহারের রাজারহাট-টাকাগছ এলাকায়। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
পাহাড় এবং সমতলের টানা বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু এলাকায়। গত বৃহস্পতিবার থেকে উত্তরবঙ্গ জুড়েই বৃষ্টি শুরু হয়। ভুটান পাহাড়েও একই সঙ্গে বৃষ্টি চলতে থাকে বলে জানা গিয়েছে। তার জেরেই শুক্রবার সকাল থেকেউ সঙ্কোশ, রায়ডাক, তোর্সা, ডুডুয়ার মতো নদী ফুঁসতে শুরু করে। কোচবিহারের দুই মহকুমা মিলিয়ে অন্তত ৩০ হাজার বাসিন্দা জলবন্দি হয়ে রয়েছেন। জেলায় ১৮টি ত্রাণ শিবিরও খোলা হয়েছে। লাল সর্তকতা জারি করতে হয় জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া তিস্তাতেও। মালদহে বিপদসীমা ছুঁয়েছে গঙ্গা ও ফুলহারও।
তোর্সা, রায়ডাক এবং সঙ্কোশ এই তিন নদী ফুলে ফেঁপে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করেছে কোচবিহারে। জেলার সদর এবং তুফানগঞ্জ মহকুমার ত্রাণ শিবিরগুলিতে তুফানগঞ্জ ২ পঞ্চায়েত সমিতি এলাকার পাঁচশোরও বেশি বাসিন্দা আশ্রয় নিয়েছেন। সঙ্কোশ ও রায়ডাকের জল ঢুকে তুফানগঞ্জ ২ ব্লকের ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করেছে। রামপুর ১ পঞ্চায়েতের নাজিরান দেউতিখাতায় বাঁধ চুইয়ে সঙ্কোশের জল ঢুকেছে। রায়ডাকের জলে প্লাবিত হয়ে পড়েছে মহিষকুচি, ঘোকসো, ঘোনাপাড়া, ছোটলাউকুঠির একাধিক গ্রাম। ফেরসাবাড়িতে সঙ্কোশ, রায়ডাক দুই নদীর জলই ঢুকেছে। বক্সিরহাট-ছোটলাউকুঠি রাস্তায় জলের তোড়ে মুরগি ভর্তি একটি ট্রাক প্রায় ২০০ মিটার ভেসে গিয়েছে। অন্যদিকে, তোর্সার জলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কোচবিহার সদরের টাকাগছ-রাজারহাট, মধুপুর, পুন্ডিবাড়ি, ঘুঘুমারি এলাকায়। কোচবিহার শহরের তোর্সা লাগোয়া ১৬ ও ১৮ নম্বরের ওয়ার্ডের কিছু এলাকাতেও জল ঢুকেছে।
সঙ্কোশ এবং রায়ডাক ২ নদীর ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত কুমারগ্রামের বেশ কিছু এলাকা। ভল্কা, ধন্দ্রা পাড়া, রিটার্ন পাড়া, পশ্চিম চিকলিগুড়ি, সংকোশ ও নিউল্যান্ডস চা বাগান এবং বনবস্তির দিকে নদী ক্রমশ পাড় ভেঙে এগিয়ে আসছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ডুয়ার্সের ধূপগুড়ি ও ফালাকাটার বিস্তীর্ণ এলাকাও। ডূডুয়া, জলঢাকা, মুজনাই, বিরকিটি, কলি, তাতাসি সহ বেশ কয়েকটি নদীর জল উপচে গ্রামে ঢুকে গিয়েছে। কেন এই পরিস্থিতি? সেচ দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, গত ৭২ ঘণ্টায় পাহাড় এবং সমতলে বেশি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুধু পরিমাণে বেশি নয়, নাগাড়ে বৃষ্টি চলায় সব নদীতেই একসঙ্গে জল বাড়তে শুরু করে। শনিবার সকালের পরে বৃষ্টি না হওয়ায় সব নদীতেই জল কমতে শুরু করেছে বলে দফতরের দাবি। বিভিন্ন এলাকার বন্যা পরিস্থিতিতে সাময়িক বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও, দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে গত জুলাই মাস থেকে উত্তরবঙ্গে অনাবৃষ্টি শুরু হয়। সে কারণে বর্ষার সময়ে নদীতে নজরদারি চালানোর কাজে কিছুটা ভাটা পড়ে। তারফলে বেশ কয়েকটি নদীর পাড় বাঁধাই হলেও দ্রুত মেরামতিতে উদ্যোগী হয়নি প্রশাসন।
সেচ দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায় কুমারগ্রাম ১২৫ মিলিমিটার, চেপানি ১২১ মিলিমিটার, বারবিসা ১০৫ মিলিমিটার, আলিপুরদুয়ার ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত শুক্রবার ও শনিবার দুদিনে হাসিমারায় মোট ৩৮০ মিলিমিটার ও আলিপুরদুয়ারে ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। সেচ মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়িতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছিল তাতে কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়। তবে বৃষ্টি কমেছে বলে জল কমতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নদী ভাঙন ঠেকাতে দফতরের ইঞ্জিনিয়রদের জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছি।”
বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলায় ত্রাণ শিবির খুলতে হয়েছিল ধূপগুড়িতেও। জল কমতেই শুরু হয়েছে ভাঙন। ফালাকাটার ডুডুয়া, কলি, তাতাসি নদীর ভাঙনে প্রায় একশ বিঘা জমি নদীগর্ভে গিয়েছে।
এক টানা বৃষ্টিতে মালদহে বিপদসীমার উপর দিয়ে বইতে শুরু করেছে ফুলহার। অসংরক্ষিত এলাকায় লালসীমার ১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে নদী বইছে বলে সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে। ফুলহারের উপচে পড়া জলে এরমধ্যেই ওই দুটি এলাকার ১৫টি গ্রামের বাসিন্দারা জলবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ। এ দিন সকালে বৃষ্টি কমলেও ফের দুপুর থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় দুর্গত এলাকায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে। ফুলহার বিপদসীমার উপর দিয়ে বইতে শুরু করায় উদ্বেগে সেচ দফতর ও প্রশাসনের কর্তারাও। উত্তরপ্রদেশ, বিহারের টানা বৃষ্টিতে গঙ্গার জলও বাড়তে শুরু করেছে। শনিবার সন্ধ্যায় বিপদসীমা পেরিয়ে যায় গঙ্গার জলও। মহান্দার নদীর জলও বাড়তে শুরু করেছে। মালদহের জেলাশাসক শরদ দ্বিবেদী বলেন, “বিডিও-সহ সেচ দফতরের কর্তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।”