রাজাভাত চা বাগানে খাঁচায় আটক চিতাবাঘ। ছবি: নারায়ণ দে।
কোন চা বাগানে কটা চিতাবাঘ ডেরা বেঁধেছে, হিসেব নেই কারও কাছে।
কোথায় লোকালয়ের কাছেপিঠে কত চিতাবাঘ কালভার্ট, পরিত্যক্ত বাড়ি, পাহাড়ি পাথুরে গুহায় লুকিয়ে রয়েছে কেউ জানে না।
অথচ, তারা যে আছে সেটা জানান দিচ্ছে মাঝেমধ্যেই। হাপিস করে দিচ্ছে গেরস্থের ছাগল-বাছুর-ভেড়া, হাঁস-মুরগি। উধাও করে দিচ্ছে পথ-কুকুর। আলিপুরদুয়ারের রাজাভাত চা বাগানে একটি কিশোরকে মেরে খুবলে খাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তাতেই টনক নড়েছে পুলিশ-প্রশাসন-বন দফতরের। পরিবেশপ্রেমীরাও গলা ছাড়তে শুরু করেছেন। দ্রুত উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলের চিতাবাঘ গণনা করে কী ভাবে মানুষের সঙ্গে সংঘাত এড়ানো যায়, তা নিয়ে সমীক্ষার কথা ভাবতে শুরু করেছে বন দফতর। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে চিতাবাঘ গণনার কাজ উত্তরবঙ্গে হয়েছিল বলে সূত্রের খবর। সেই রিপোর্ট অবশ্য এখনও সরকারের হাতে আসেনি। বনমন্ত্রী জানান, চিতাবাঘের উপরে গণনা সংক্রান্ত কোনও রিপোর্ট তাঁদের কাছে নেই।
সোমবার দুপুরে বিষয়টি নিয়ে ঘরোয়া আলোচনাও হয়েছে রাজ্য বন দফতরে। শিলিগুড়িতে সুকনায় হাতি-মানুষ সংঘাত এড়াতে মনিটরিং সেলের বৈঠকেও বিষয়টি উঠেছে। বিশদে খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন বনমন্ত্রী বিনয় বর্মনও। বনমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘পর পর লোকালয়ে চিতাবাঘের হানার ঘটনা ঘটছে। ধরা পড়ছে। জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ফের একই জায়গায় হানা দিচ্ছে। চিতাবাঘের সংখ্যা বেশি বেড়ে গিয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। তাই চিতাবাঘ গণনার কথা ভাবা হচ্ছে। বিধি খতিয়ে দেখে শীঘ্রই পদক্ষেপ করব।’’ বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন বলেন, ‘‘চিতাবাঘ বেড়ে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। গণনা নিয়ে চিন্তা শুরু হয়েছে। সব দিক খতিয়ে দেখে এগোতে চাইছি।’’
ঘটনা হল, তাঁর দলের তরাই-ডুয়ার্সের জন প্রতিনিধিদের কাছ থেকেও বনমন্ত্রীকে নিয়মিত চিতাবাঘ-মানুষ সংঘাতের কথা শুনতে হচ্ছে। যেমন মালবাজারের কথাই ধরা যাক। সেখানে রাঙামাটি চা বাগানে থাকেন তৃণমূলের মালের বিধায়ক বুলু চিকবরাইক। তাঁর দেহরক্ষী রয়েছে। তবু সন্ধ্যার পরে এলাকায় যাতায়াত করতে ভয় পান। কারণ, গত এক মাসের মধ্যে তাঁরা যে বাগানে থাকেন, সেই রাঙামাটি থেকে উধাও হয়েছে অন্তত ১০টি ছাগল, ৫টি কুকুর, ৪টি বাছুর ও বেশ কয়েকটি হাঁস-মুরগিও। বুলবাবু বললেন, ‘‘এক মাসে আমাদের বাগান থেকে ৪টি চিতাবাঘ ধরা পড়েছে। খাঁচায় নিয়ে তা দূরে ছাড়া হয়েছে। আবার ফিরে এসে অত্যাচার চালাচ্ছে। বনমন্ত্রীকে সব বলেছি। চিতাবাঘ বাড়ছে না কমছে সেটা জানা দরকার। সে জন্য গণনা করে সেই মতো পা ফেলতে হবে।’’
পরিবেশপ্রেমী সংস্থা ন্যাসের সম্পাদক অরূপ গুহ মনে করেন, চিতাবাঘ সংরক্ষণের ব্যাপারে কিছুটা উদাসীনতা রয়েছে বলেই সমস্যা বাড়ছে। তাঁর মতে, ‘‘চিতাবাঘ মূলত মানুষখেকো নয়। কিন্তু, শাবক হলে মা চিতাবাঘ সন্তানের নিরাপত্তার জন্য হায়না, শেয়ালের মতো প্রাণীদের নিয়ে আতঙ্কে থাকে। শাবকের নিরাপত্তার জন্য নিরিবিলি জায়গায় বারবার আশ্রয় বদল করে। জঙ্গল ও নিরিবিলি এলাকা দুইই কমছে। ফলে মাঝেমধ্যে ওই প্রাণীরা লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। গণনা হলে একটা স্পষ্ট চিত্র তো পাওয়া যাবেই। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধে হবে।”
কিন্তু, সারা দেশেই তো সরকারি স্তরে আজ অবধি পূর্ণাঙ্গ চিতাবাঘ গণনা হয়নি। বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৫ সালে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে সরকারি ভাবে চিতাবাঘ গণনা হয়। সেখানে ওই কটি এলাকায় আনুমানিক ১২ হাজার চিতাবাঘ আছে বলে রিপোর্টে
উল্লেখ রয়েছে।
উত্তরবঙ্গের বন্যপ্রাণ বিভাগের বনপাল সুমিতা ঘটক বলেন, ‘‘চা-বাগান এলাকায় কত চিতাবাঘ রয়েছে তার একটা হিসাব কী ভাবে তৈরি করা যাবে সেটাই ভাবতে হবে।’’
তবে গণনা কবে হবে সেই আশায় বসে থাকতে রাজি নন চা বাগানের বাসিন্দারা। আদিবাসী বিকাশ পরিষদের চা শ্রমিক সংগঠনের নেতা অমরদান বাক্সলা বলেন, ‘‘খাঁচায় ধরার পরে রেডিও কলার লাগানো যায় কি না সেটা পরীক্ষা হোক। তাহলে গতিবিধিটা তো বোঝা যাবে।’’
পরিবেশপ্রেমী অনিমেষ বসু বলেন, ‘‘সরকারি পর্যায়ে গণনা হোক। তার পর রূপরেখা তৈরি করে কাজ করতে হবে।’’