একটি ছাগল কিনবে বলে চার দিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রহিমা বিবি। আজ, অফিসার নেই। কাল, ব্যস্ততা। পরশু, ক্যাম্পে যাওয়া যাবে না। এই করে চার দিন পরে অনুমতি পেলেন তিনি।
হাট থেকে ছাগল নিয়ে আসার পথে আবার দফায় দফায় জেরার মুখে পড়তে হল তাঁকে। ব্যাগে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা সেই অনুমতি পত্র বের করে দেখানোর পরে ছাগল পৌঁছলো গ্রামে। গরুতে তো আরও ঝক্কি। কেন গরু কেনা হবে আর কেন বিক্রি করা হবে? সে উত্তর কষতে কষতে অনেক জল গড়িয়ে যায়। এক বাসিন্দা বলেন, “হালের গরু কিনবো বলে অনুমতি দিতে আমাকে চোদ্দো দিন ঘোরানো হল। একবার হেড কোয়ার্টার কোচবিহার শহরে পাঠানো হল। কেনার পরে গরুর সঙ্গে আমার ছবি তুলে রাখা হল।”
দিনহাটার বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামে চোরাকারবারীদের দৌরাত্ম্যের কথা কারও অজানা নয়। প্রায় নিত্য দিন গরু থেকে শুরু করে নানা সামগ্রী পাচারের অভিযোগ উঠছে। কেউ কেউ ধরাও পড়ছে। সেই কারবারীদেরই রুখতে সীমান্তে গ্রামে এমনই আইন জারি করা হয়েছে বলে বিএসএফ সূত্রের। বাসিন্দাদের প্রশ্ন এখান থেকেই। দুষ্কৃতীদের ধরার বদলে বাসিন্দাদের উপরে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে আখেরে সাধারণ মানুষকে সমস্যার মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? ভোট প্রচারে গিয়ে ডান-বাম সব দলের প্রার্থীরাই ওই প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন সীমান্তবর্তী গ্রামে। এই সমস্যার হাত থেকে বাঁচাতে তাঁরা কী পদক্ষেপ করবেন তা নিয়েও জানতে চাইছেন মানুষ। বাসিন্দারা বলেন, “আমরা অন্য জায়গার বাসিন্দাদের মতো কেন বসবাস করতে পারব না। কে চুরি করছেন, কে অপরাধ করছেন, সে জন্য তো গোটা গ্রামকে শাস্তি দেওয়া যায় না।” নাজিরহাট-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলের উপপ্রধান জহিরুল হকও অসহায়ের মতো বলেন, “গরু, ছাগল নয়, কেউ মোটরবাইক কিনবেন, তাতেও অনুমতি লাগে। কী যে অসুবিধের মধ্যে আছি আমরা বলতে পারব না।”
এখানেই শেষ নয়, রাতে ওই এলাকায় গাড়ি চলাচলে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কারও কোনও কারণে বাড়ি ফিরতে রাত হলে পঞ্চাশ মিটারের মধ্যে কমপক্ষে দুইবার বিএসএফের জেরার মুখে পড়তে হয়। এক বাসিন্দা বলেন, “রাতে বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার গাড়ি পাই না আমরা। বিএসএফের অনুমতি নিয়ে গাড়ি সংগ্রহ করার পরে বেরোতে হয়। তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।” দিনহাটার অধিকাংশ এলাকা সীমান্ত ঘেঁষা। সব জায়গায় কাটাতারের ব্যবস্থা নেই। কোথাও নদী পথ কাটাতারে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও আবার সীমানা এমন ভাবে ভাগ হয়েছে যে গোটা এলাকা কাঁটাতার দেওয়ার কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি প্রশাসন।
ওই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চোরাকারবারীরা সক্রিয় সেখানে। গীতালদহেরর জারিধরলা, দরিবস থেকে শালমারার ছোট গাড়োলঝোরা সমস্যা রয়েছে সর্বত্র। বিএসএফের এক আধিকারিক অবশ্য বলেন, “অন্য এলাকার মতো দেদারে জিনিস নিয়ে যাওয়ার অনুমতি থাকলে সেই সুযোগ চোরাকারবারীরা নেয়। সে জন্যই কিছু বিধিনিষেধ সীমান্ত এলাকায় চলে।”
ইতিমধ্যেই সীমান্তের সব এলাকাতেই প্রচারে গিয়েছিলেন শাসক দল তৃণমূলের দিনহাটা কেন্দ্রের প্রার্থী উদয়ন গুহ, বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী অক্ষয় ঠাকুর। ফরওয়ার্ড ব্লক দাবি করেছে, সীমান্তের সমস্যা নিয়ে তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। সাধারণ মানুষকে যাতে হেনস্থা না করা হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি তাঁদের পুরনো। অক্ষয়বাবুর ছায়াসঙ্গী যুবলিগের রাজ্য সম্পাদক আব্দুর রউফ নিজে সীমান্ত এলাকা নাজিরহাটের বাসিন্দা। তিনি বলেন, “সীমান্তের মানুষদের পাশে থাকি।” শাসক দলের প্রার্থী উদয়নবাবু বলেন, “সীমান্তের মানুষের পাশে আমরা সব সময় ছিলাম। ছিটমহল নিয়ে কমল গুহ আন্দোলন করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমাধান করেছেন। আমই যখন ফরওয়ার্ড ব্লকে ছিলাম তখন আন্দোলন করেছি। এখনও আন্দোলন করছি।”